ঢাকা শহরে তখন রংদার হাতিরঝিলের ফানুস-ফুর্তি। টগবগা টক শো। ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাকামীদের হাঁকডাক। গাড়িবহর, আলো, জ্যাম, মউজ, স্টার জলসা, সুগন্ধি ধোঁয়ায় মোহনীয় সিসা ক্যাফে, পাঁচতারা হোটেলের রঙিন ফোয়ারা, নতুন কেনা সাবমেরিন আর বাংলাদেশি আইডলদের সুঠাম পেশি, বাণিজ্যমেলা আর কী সুন্দর সুবেশী মানুষদের সুখ। মুনাফার খুন এখানে ব্যাপার না। গরিব মানুষ আর না খেয়ে মরে না, আগুনে আর দমবন্ধ হয়ে মরে। গ্রুপ ধর্ষণে মরে।
সাত বোন ঘুমালেও জেগে উঠেছে সরকারযন্ত্র। সিকদার মেডিকেলে বড় বড় গাড়ি যাচ্ছে আর আসছে। স্থানীয় সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক চলে এসেছেন সন্ধ্যার দিকে। এসেছেন শ্রমমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশের বড় কর্মকর্তা, রেডক্রসের লাশবাহী গাড়ি সবই আছে। সাংবাদিকেরা ঠান্ডা মুখে খবরাখবর নিচ্ছেন। মন্ত্রী মহোদয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সবাই গম্ভীর ও ব্যস্ত।
জরুরি বিভাগের একটি ঘরের বেঞ্চিতে বসে আছেন পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী পুরুষ। পরনে লুঙ্গি, মুখে কথায় চাহনিতে দারিদ্র্যের অক্ষয় কারুকাজ। এঁরা কেউ নিহত নাসিমার ভাই, কেউ ফাতেমা বা লাইজুর বাবা। এঁদের উদ্দেশে দীর্ঘ বক্তৃতা করছেন মন্ত্রী সাহেবের এপিএস মিজান। খুবই পরিষ্কার দায়িত্বশীল কথা: ‘মুসলমানের লাশ, কবর দিতে যত দেরি করবা, তত গোর আজাব বাড়ব। পোস্টমর্টেম করাবা কি না, ভাইবা দেখো। চাইলে লাশ এখনি বাড়ি নিতে পারবা। অ্যাম্বুলেন্স খরচাপাতি সব রেডি।’ যা বোঝার বুঝে নিলাম। এঁরা দায় এড়াতে চাইছেন। অপমৃত্যুর মামলা হলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দরকার হবে। তাতে যদি প্রমাণ হয় আগুনের কারণে মৃত্যু হয়েছে, তাহলে মালিকের দায় থাকবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে লাশ পাঠিয়ে খালাস হওয়া গেলে মালিকও বাঁচেন, মালিকদের সরকারও বাঁচে।
কিন্তু ফাতেমার ভাই লোকটি বেঁকে বসেন। কেউ তাঁকে বুঝিয়েছেন, ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া ক্ষতিপূরণ পাওয়া কঠিন হবে। অবশেষে সেই সার্টিফিকেট মিলল বটে, তবে সেটা অপমৃত্যুর নয়, হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর। ডাক্তার সই করেছেন, সরকারি লোকজন মধ্যস্থতা করেছেন। সবাই মিলে মালিকের দায় খালাসের যৌথ দায়িত্ব পালন করছেন। ঠিক যেমন সবাই মিলে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকের ঢাল হয়েছেন, তেমন। কী অদ্ভুত শ্রেণীসংহতি! নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও জানেন, এঁদের কথার বাইরে গিয়ে লাভ নেই। তাজরীনের ঘটনার পর তাঁরাও হয়তো বুঝে গেছেন, পোস্টমর্টেম ইত্যাদির পর দায়িত্ব নেওয়ার লোক পাওয়া যাবে না। হয়তো লাশের সংখ্যাও কমে যাবে। মর্গে ঘুষ দিতে হবে, যাতে কাটা লাশ যত্ন করে সেলাই করে লাগিয়ে দেওয়া হয়। যাতে গাড়ির ঝাঁকুনিতে লাশের সেলাই ছুটে না যায়। তাঁরা হাড়ে হাড়ে হাড়ে জানেন, গরিবের জীবনের বদলায় বিচার হয় না, বিহিত হয় না। সরকার নয়, ভাগ্যকেই তাঁরা দোষান।
বাংলাদেশ এখন পোশাকশ্রমিকের ইহকালীন জাহান্নাম! আদিম পরিবেশে কোনো প্রাণীকে ক্ষুধা মেটানোর জন্য যতটা খাটতে হতো, এঁদের খাটতে হয় তার চেয়ে বেশি। তাঁদের জীবন তাই মানবিক নয়, নারকীয়রকম প্রাণবিক। যে জীবন মানুষের না, সেই জীবনের দায় তাই কারও না। জীবন-মৃত্যুর ম্যানেজাররা তাই তাঁদের মরণে নির্বিকার। মৃত্যুর মিছিল বড় হয়, আহু-উহুও দীর্ঘ হয়।
সবই ওপরওয়ালাদের ইচ্ছা। ওপরওয়ালারা খোঁজ রাখেননি, স্মার্ট ফ্যাশনে সেদিন ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি, বেরোনোর প্রধান সিঁড়িটি বন্ধ ছিল, সরু অন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই পায়ের তলায় পিষ্ট হন অনেকে। সর্বদাই কেন কারখানার গেট বন্ধ থাকে? যদি শ্রমিকেরা ফাঁকি দেন, দু-চার শ টাকার কাপড় নিয়ে পালান? দু-চার শ বা হাজার টাকার চেয়ে শ্রমিকের জীবনের দাম তো কমই, তাই না?
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মালিকদের মুনাফার হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৪৩.১০ শতাংশ। কম্বোডিয়ায় ৩১, ভারতে ১১.৮, ইন্দোনেশিয়ায় ১০, ভিয়েতনামে ৬.৫, নেপালে ৪.৪ এবং চীনে ৩.২ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের মালিকেরা বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে, সবচেয়ে বেশি সরকারি সুবিধা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছেন। এঁদের অনেকের বাড়িতে ভূগর্ভস্থ সুইমিংপুল পর্যন্ত আছে। সাদ্দাতের এই বেহেশতবাসীদের চোখে শ্রমিকেরা দাস ছাড়া আর কিছু নন। গার্মেন্ট ব্যবসা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দাসব্যবসা। এই দাসদের ৮০ ভাগই অল্পবয়সী নারী। বিকৃত পরিবেশে কাজ করতে করতে স্বাস্থ্য যায় ভেঙে। এঁদের অনেকেরই বিকলাঙ্গ সন্তান হচ্ছে। চল্লিশের পর এঁদের শরীরে আর কিছু থাকার কথা নয়। এই কথা জানা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার আমাদের রপ্তানি করা পোশাককে জিএসপি-সুবিধার বাইরে রেখে অনেক ট্যারিফ আদায় করে। দেশি মালিকদের মুনাফার কয়েক শতাংশ কিংবা মার্কিন সরকারের ট্যারিফের কিছু অংশ কমালেই অজস্র শ্রমিকের জীবন বাঁচে। অথচ এরা আর ওরা সবাই-ই নির্বিকার।
তখনো লাশগুলোর পায়ের কাছে, মাথার কাছে বসা আত্মীয় নারীরা দুলে দুলে কাঁদছেন। গ্রামীণ নারীরা সব। জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসেছেন। ক্ষুদ্রঋণ সহায় হয়নি, সরকারি কর্মসূচির সুবাদেও অভাব যায়নি। এনজিওগুলোর সেবাজালের বড় বড় ফোকর গলে তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছেন। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও সহস্র বছরের কৃষক বঞ্চনার থই পায়নি। এগুলো শহুরে সুশীলীয় স্লোগান, ভদ্রলোকে বলে ভদ্রলোকে শোনে আর অন্য ভদ্রলোকেরা হাততালি দেয়। অন্যদিকে কুড়িগ্রামের রাজাপুর, রংপুরের কাউনিয়া, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ এবং ভোলা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, মাগুরা থেকে দলে দলে মানুষ আসে। গ্রামে তাদের নিজস্ব নাম-পরিচয়-সমাজ ছিল, অভাবের মধ্যেও একধরনের সামাজিকতা ছিল। সব ছেড়ে এরা নাম-পরিচয়হীন উপহাসিত ‘মফিজ’ হয়ে যায়। মেয়েদের অবশ্য গালভরা নামে বস্ত্রবালিকা ডাকা হয়। যেন শ্রমিক নয়, মানুষ নয়, নাগরিক নয়; কেবলই বস্ত্র আর বালিকার যৌনায়িত সমাবেশ!
এঁদেরই একজন দুদিন আগে মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ডাবল ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এঁদের চলাচলের পথে নিত্যদিন পুরুষালি উৎপাত। কারখানার পরিবেশ অসম্মানকর। বস্তিতে একঘরে ১০ থেকে ১২ জনের জীবন মুরগির খোঁয়াড়ের সমান। অথচ এঁরাই দুভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে বলবান রাখেন। প্রথমত, এঁদের শ্রমে বিদেশি ডলারের ঢলে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, ধনী আরও ধনী হন, সরকার বুক ফুলায়। দ্বিতীয়ত, গ্রামে টাকা পাঠান বলে গ্রামের অর্থনীতিতেও গতি আসে। বিপরীতে, ধনীদের একটা অংশ গ্রাম-মফস্বল থেকে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে বিদেশে সম্পদ ও পুঁজি পাচার করে দেশের ক্ষতি করে।
দেশি শিল্প খাতেও এঁদের অবদান বিরাট। দেশি শাড়ি-কাপড়, জামা-জুতা, প্রসাধনসামগ্রী আর সস্তা ইলেকট্রনিকস-শিল্পের প্রধান ক্রেতা এঁরা। হাতি যেমন জানে না তার শক্তি কতটা, এঁরাও তেমনি এঁদের সংখ্যাগত শক্তি ও পেশাগত অবদানের পরিমাপ পুরোটা করে উঠতে পারেন না। পারলে পার্থিব জাহান্নামে পুড়ে শুধু আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতেন না। সরকারের কাছে, মালিকশ্রেণীর কাছে জবাবদিহি চাইতেন। ক্ষোভে-রাগে ফুঁসে উঠতেন। শনিবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের সিকদার মেডিকেল কলেজে জড়ো হওয়া কয়েক শ শ্রমিকের মধ্যে সেই ন্যায্য ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখিনি। প্রতিবাদের জন্য বুকের মধ্যে যতটা বারুদ থাকা প্রয়োজন, শহরের শিকড় ছাড়া অমানবিক পরিবেশে সেই সংস্কৃতি দানা বাঁধতে হয়তো আরও দেরি আছে। তত দিন গার্মেন্ট ব্যবসা নামক গণবিধ্বংসী যন্ত্র এঁদের শুষে পুড়িয়ে ছিবড়ে করে ফেলে দেবে। তাই এঁরা ভাগ্যকে দোষান। এঁরা তবু বিশ্বাস করেন, সরকার তাঁদের মা-বাপ। তা সত্যি, তবে আপন নয়, সৎ মা-বাপ। সরকারের আসল পক্ষপাত দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ মালিকদের প্রতি।
এই শিল্প বাঁচাতে হলে কিছু দুর্বৃত্ত মালিককে অবহেলা আর নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে হবে। উদ্যোক্তাদেরও বুঝতে হবে, সোনার হাঁস মেরে ফেললে আখেরে দুর্দিন নামবে। একের পাপ সবে মিলে বইবেন কেন, এই বোধও তাঁদের মধ্যে জাগতে হবে। আজ যদি তাজরীন আর স্মার্ট ফ্যাশনের মালিকদের বিচার করা হয়, তাহলে অন্য দুর্বৃত্তরাও ভয় পাবে। দায়িত্বশীল উদ্যোক্তারাও তখন সচেতন হবেন। শিল্পের স্বার্থেই শ্রমিকের জন্য মানুষের মতো জীবনের ব্যবস্থা করবেন। সবই হতে পারে, যদি সরকার, মানে জীবন-মৃত্যু আর মুনাফার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয়।
নইলে লাশ দেখতে দেখতে একদিন নিজেদের লাশকেও মনে হবে সহজ স্বাভাবিক সহনীয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com
গোলটেবিল বৈঠক
0 comments:
Post a Comment