প্রতিবছর এখানে অসংখ্য মানুষ আসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এক নিষ্ঠুর চক্রান্তে মেতে উঠেছিল। মেধা-মনন-সৃজনশীলতায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তারা হত্যা করে বাঙালিকে মেধাহীন করে তুলতে চেয়েছিল। অত্যন্ত দুঃখজনক যে তাদের সহায়তা করেছিল আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ। রাজাকার, আলবদররা ঘাতকদের চিনিয়ে দিয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের ঠিকানা। পরিবারের স্বজনদের সামনে থেকে ঘাতকেরা সেই সোনার মানুষদের তুলে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। ৪০ বছর পর হলেও এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এবং ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় তাঁদের অনেককেই কমবেশি চিনতাম। জি সি দেব স্যারের কথা মনে পড়ছে। সব সময় একটি ধ্যানস্থ ভাব বিরাজ করত এই দার্শনিক মানুষটির মধ্যে। চোখের সামনে ভাসছে সেই দৃশ্য—যেন গভীর কোনো ভাবনায় আত্মনিমগ্ন হয়ে আছেন। চারপাশের কোনো দিকে খেয়াল নেই। কলাভবন থেকে ধীরে ধীরে পা ফেলে হেঁটে হেঁটে জগন্নাথ হলের দিকে চলে যাচ্ছেন তিনি।
মুনীর চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। মেধা, সৃজনশীলতা, অমায়িক ব্যবহার—সব মিলিয়ে এমন মানুষ কোনো যুগেই খুব বেশি মেলে না। মনে পড়ছে শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হানের কথা। আহা, কী অনন্য, অসাধারণ মানুষ ছিলেন তাঁরা! তাঁদের অভাব কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়।
বিজয়ের পর সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা এসেছিলাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিগুলোতে। রায়েরবাজারের এই বধ্যভূমিতে আমরা যখন এসেছিলাম, তার আগেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমারা এসেছিলাম ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝ নাগাদ। তারিখটা ঠিক মনে নেই। পরে আমরা গিয়েছিলাম মিরপুরে; জহির রায়হানের খোঁজ নেওয়ার জন্য। তিনি মিরপুরে নিখোঁজ হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলেও ওই সময়টায় মিরপুরে যাওয়া বেশ বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি।
আজ ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় আমি এসেছি রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। আকাশ কুয়াশায় ঢেকে আছে। মাঝে মাঝে মেঘের কিনার দিয়ে সূর্যের উষ্ণ কোমল রোদ এসে পড়ছে সৌধের প্রাচীরের গায়ে। দুই দিন পর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। অগণিত মানুষ আসবে শ্রদ্ধা জানাতে। তাই সৌধ চত্বরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। শুকিয়ে আসা ঘাসগুলোতে পানি ছিটানো হচ্ছে। ইট বাঁধা চত্বরে ব্রাশ ঘষে সারা বছরের জমে থাকা ময়লা অপসারণের কাজ চলছে। জাতির গৌরবের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থান ও স্থাপনাগুলোকে সারা বছর অবহেলা-অযত্নে ফেলে রেখে নির্দিষ্ট দিনে পরিচ্ছন্ন করার আমাদের এই যে সংস্কৃতি, ব্যক্তিগতভাবে তা মানতে পারি না। বিশ্বের কোথাও এমনটা হয় না। সবাই নিজেদের গৌরবের স্থানগুলোকে সারা বছর অত্যন্ত যত্নে রাখেন। প্রতিটি দিন নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। আমরা সারা বছর এসব স্থাপনা উপেক্ষা-অবহেলায় ফেলে রাখি বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে তার পরিচর্যার জন্য।
১৫-১৬ বছরের এক কিশোরের সঙ্গে কথা বললাম। সে এসেছিল এখানে কী হচ্ছে দেখতে। এটা যে একটা স্মৃতিসৌধ, এটুকুই সে বলতে পারল। কিন্তু কাদের জন্য, কেন এই স্মৃতিসৌধ, সে বিষয়ে তার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। না জানাটা আমি ওই কিশোরের কোনো ব্যর্থতা বলে মনে করি না। ব্যর্থতা আমাদেরই, তাদের আমরা এত বড় ঘটনাটি জানাতে পারিনি। যেতে পারিনি তাদের কাছে। এ রকম অনেক বিষয়ই আছে, যা তরুণ প্রজন্মের জানা প্রয়োজন, কিন্তু আমরা জানাতে পারছি না। একটা ছোট্ট বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। দেখেছি, অনেক স্কুলেই জাতীয় সংগীতও ছেলেমেয়েরা শুদ্ধ করে গাইতে পারে না। তাদের তা শেখানোই হয়নি। আমি নীতিনির্ধারক মহলে বলেছিলাম, সব জেলাতেই এখন শিল্পকলা একাডেমীর শাখা রয়েছে। অনেক উপজেলায়ও আছে। একাডেমীর পক্ষ থেকে প্রতিটি জেলার সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে শুদ্ধ করে জাতীয় সংগীত শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। সাধারণ মানুষ অসংগঠিত থাকে। তাদের জানাতে হয়, বোঝাতে হয়, সংগঠিত করতে হয়। এ কাজ রাজনীতিকদেরই। আমরা রাজনীতিকেরা শতভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করতে পারছি না।
আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া। এর শুরু আছে, শেষ নেই। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজও নতুন নতুন সমস্যা-সংকটের মুখোমুখি হয়। দুর্নীতি, কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার, বৈষম্য, উগ্রপন্থা, সন্ত্রাস, ধর্মীয় উন্মাদনা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন—এসব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই এগিয়ে যেতে হয়। সমাজজীবনে নতুন অনুসঙ্গ যুক্ত হয়। নতুন ভাবনার উন্মেষ ঘটে। নতুন যুগের সঙ্গে সমাজকে সমন্বিত করে তুলতে হয়। এটিই মুক্তির সংগ্রাম। এই ধারাবাহিক সংগ্রাম চলবে। এতে বিরতির কোনো অবকাশ নেই।
একটি জাতির জীবনে ৪১ বছর খুব বেশি সময় নয়। হয়তো আমরা এই সময়ে আমাদের প্রত্যাশিত অগ্রগতি লাভ করতে পারিনি। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই বাঙালি তার অন্তর্গত সাহস ও শক্তিতে এগিয়ে চলেছে। নানা ক্ষেত্রেই আমাদের অর্জন একেবারে ছোট করে দেখার মতো নয়। প্রতিবছরের মতো এবারও ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অসংখ্য শিশু, নারী, পুরুষ এখানে আসবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ ও তাঁদের চিরভাস্বর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি উদার গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত স্বদেশ হিসেবে গড়ে তোলার শপথ নেবে। আমি খুবই আশাবাদী যে বাঙালি পারবেই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে।
আসাদুজ্জামান নূর: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদ।প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment