কলার চাষ করে ভাগ্য বদলে ফেলেছেন তিনি। তাঁর পরামর্শে জৈব সার ব্যবহার করে কলা চাষের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের অনেকেই আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি কর্মসংস্থানও হয়েছে শত শত মানুষের।
সংগ্রাম: ১৯৭০ সালে জন্ম নুর মোহাম্মদের। বাবা ছিলেন দিনমজুর। তাঁর জন্মের প্রায় দুই মাস আগে বাবা মারা যান। নয় মাস বয়সে হারান মাকে। দাদি তাঁকে ভিক্ষা করে লালন-পালন করেন। একসময় দাদি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চোখেও ভালো দেখতেন না। তার পরও দাদিকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে বেড়াতেন নুর। ১৯৮২ সালে একদিন ভিক্ষা শেষে ফেরার পথে মারা যান দাদি। গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে দাফনের ব্যবস্থা করে। দাফনের পর বেঁচে যাওয়া প্রায় ৭০০ টাকা নুর মোহাম্মদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে একটি ছাগল কেনেন। ছাগল রাখার জায়গা না থাকায় তা বর্গা দেন স্থানীয় একজনকে। পরে গ্রামের এক বাড়িতে রাখালের কাজ শুরু করেন। সেখানে কাটে দুই বছর।
এরপর শুরু করেন দিনমজুরি। কিন্তু এলাকায় সব সময় কাজ থাকে না। তাই যান পাশের উপজেলা পীরগঞ্জের রামনাথপুর গ্রামে। ওই গ্রামের আ. খালেকের বাড়িতে কাজ নেন কলার খেত পরিচর্যার। নুর মোহাম্মদের কষ্টের কথা শুনে তিনি তাঁকে কলা চাষের পরামর্শ দেন।
কলাপল্লিতে এক দিন: পীরগাছা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে কৈকুড়ী ইউনিয়নের নজরমামুদ গ্রাম। কাঁচা-পাকা পথ ধরে নুরের বাড়ি যাওয়ার পথে ওই গ্রামে ঢুকতেই অসংখ্য কলাখেত নজর কাড়ে। অনেকেই ব্যস্ত সেই খেত পরিচর্যায়।
নুরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর খোঁজ করলে জানা গেল, তিনি খেত পরিচর্যায় ব্যস্ত। খেতে গিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, তাঁর সংগ্রামী জীবনের কাহিনি।
শুরুর কথা: নুর প্রায় নয় মাস রামনাথপুরে কাজ করার পর নজরমামুদ গ্রামে ফিরে আসেন। বর্গা দেওয়া সেই ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে অন্যের ২৫ শতক জমি বর্গা নেন। সেই জমিতে কলার চারা লাগান। ১১ মাসের মাথায় খেতে কলা ধরে। ফলন দেখে নুরের মুখে হাসি ফোটে। এই কলা বিক্রি করে আয়ও হয় প্রায় ১৪ হাজার টাকা। এরপর পুরোপুরি কলা চাষে লেগে পড়েন।
এর মধ্যে বিয়েও করেন নুর। স্ত্রী আনিছা বেগমও তাঁর কাজে হাত লাগান। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গবাদিপশুর গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা সংগ্রহের মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করে জমিতে দেন। প্রথম বছরের ১৪ হাজার টাকা দিয়ে পরের বছর ৭০ শতক জমি বর্গা নিয়ে আবার কলার চাষ করেন। কলা বিক্রি করে এবার আয় করেন ৭৯ হাজার টাকা।
এভাবে একপর্যায়ে চাষের জমি বাড়ে, আয় বাড়ে, অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা। ভিক্ষুক থেকে নুর একসময় হয়ে ওঠেন সফল চাষি। কলা চাষের টাকায় কেনেন তিন একর জমি, বানান টিনের বাড়ি। ছয়টি গাভির একটি খামারও আছে তাঁর। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে স্কুলে পড়ছে।
এবার তিন একর জমিতে কলার চাষ করেছেন নুর। ইতিমধ্যে দুই লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন। আরও দুই লাখ টাকার কলা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
সফল যাঁরা: নুরের দেখাদেখি কলা চাষ করে তাঁর গ্রামের অনেকে ভাগ্য বদল করেছেন। নজরমামুদ গ্রামের পাশের গ্রাম দাদন। এই গ্রামের আয়নুল হক ছিলেন দিনমজুর। নুরের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে কলা চাষ করে সফল হয়েছেন তিনিও। ১০ বছরের ব্যবধানে টিনের বাড়ি করেছেন, দেড় একর জমি কিনেছেন।
পাশের গ্রাম চালুনিয়ার আ. রহমান বলেন, কলা চাষ করে তাঁর সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। আগে এক বেলা খাবার জোগাড় করাই কষ্ট হতো, এখন খাওয়া-পরা বাদেও নিজের খরচে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারছেন।
কাজ জুটেছে অনেকের: কলাখেতে শ্রম দিয়ে এলাকার শত শত দিনমজুর সংসার চালাচ্ছেন। নজরমামুদ গ্রামের দিনমজুর আকবর আলী বলেন, কলাখেতে কাজ করে দৈনিক ২০০ টাকা আয় হচ্ছে।
আটপাড়া গ্রামের কলার ব্যবসায়ী মমিনুল হক ও জিকরুল হক জানান, তাঁরা খেত থেকে কলা কিনে ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছেন। বর্তমান স্থানীয় বাজারে ১০০টি কলার দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
খরচ কম, লাভ বেশি: নজরমামুদের পাশের আলাদীপাড়া গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেন জানান, ধানের চেয়ে কলা চাষে লাভ দ্বিগুণ। এক বিঘা (৬০ শতক) জমিতে ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। উৎপাদিত ধান বিক্রি হয় ১৮ থেকে ১৯ হাজার টাকা। এতে লাভ হয় মোটামুটি আট থেকে নয় হাজার টাকা। কিন্তু এক বিঘা জমিতে কলা চাষে ব্যয় ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। সেই কলা বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা। লাভ আসে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা।
তাঁরা যা বলেন: উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফতাব হোসেন জানান, নুর মোহাম্মদকে দেখে কৃষকেরা জৈব প্রযুক্তিতে কলার চাষ করছেন। এখানকার কলা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। এবার ৯২০ একর জমিতে কলার চাষ হয়েছে। চাষিদের উৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নুরের কথা: অতীতের কথা মনে পড়লে বুকটা হু হু করে ওঠে নুরের, ‘একমুঠো খাবারের জন্য রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। দাদির সঙ্গে সারা দিন ভিক্ষা করেও বহুদিন খাবার জোটাতে পারিনি।’
এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে জবাব দেন তাঁর স্ত্রী আনিছা, ‘আগোত সমাজোত হামার কোনো দাম আছলো না। এলা ভালো কৃষকের বউ হিসাবে মোর গর্ব হয়।’ prothom-alo
0 comments:
Post a Comment