এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে অনেকে হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করে বসবেন, তাহলে সাগরে আর থাকলটা কী?
সাগরের নীল জলরাশিতে তিমির ভুশ করে ভেসে ওঠা, হাঙরের সদর্প ঘোরাফেরা আর সাঁতারের মধ্যে অন্য রকম এক সৌন্দর্য রয়েছে। ডলফিনের ডিগবাজি যেন সাগরের জীবন্ত উচ্ছ্বাস। এসব সামুদ্রিক প্রাণী হারিয়ে গেলে নির্জীব এক জলাধারে পরিণত হবে সাগর। অথচ বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যতে এমন এক সাগরের আশঙ্কায় শঙ্কিত, যেখানে হতাশা ভরা দুঃখগাথা ছাড়া কিছুই থাকবে না।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সাগরে শিকারিদের ব্যাপক শিকারের কারণে তিমি, হাঙর, কচ্ছপের মতো বড় বড় সামুদ্রিক প্রাণী দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রথমে কচ্ছপের কথাই ধরা যাক। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণী এটি। সময় নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও লক্ষ-কোটি বছরের এই পৃথিবীতে এখনো টিকে আছে এই কচ্ছপ। যারা দেড় কোটি বছর আগে বিরাট দাঁতালো হাঙরের সঙ্গে সাঁতরে বেড়িয়েছে। এরও বহু আগে ডাইনোসরদের সঙ্গে পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। সেই কচ্ছপের আর মাত্র আটটি প্রজাতি বর্তমানে টিকে আছে। এর মধ্যে কচ্ছপের একটি প্রজাতি লম্বায় ১০ ফুট ও প্রায় দুই টন ওজনের হয়ে থাকে। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরীসৃপ বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। এর মূলে আর কিছুই নয়, মানুষের হাতে ব্যাপক হারে কচ্ছপ নিধন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত ৩০ বছরে মানবসৃষ্ট নানা দূষণ বা কর্মকাণ্ডে সমুদ্রের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা অতীতের সব পরিবর্তনকে যেন হার মানিয়েছে।
বিশ্বের প্রায় সব স্থানেই মাছ ধরা ও প্রাণী শিকারের কবলে পড়ে ৭৫ শতাংশেরও বেশি বৃহদাকার সামুদ্রিক প্রাণী বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে হাঙর, তিমি, ডলফিন, রে ও কচ্ছপ। সাদা হাঙর, আমেরিকান করাত মাছ তো বলতে গেলে ৯৯ শতাংশেরও বেশি এখন হারিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অব ওশানোগ্রাফির স্নাতক লরেন ম্যাকক্লেনাচেন ফ্লোরিডার পর্যটন নগর ‘কি ওয়েস্ট’ শহরের এক গ্রন্থাগারে কয়েক দশকের মাছ ধরার ওপর কিছু ছবি খুঁজে পান। তিনি দেখলেন, পঞ্চাশের দশকে কি ওয়েস্ট শহরের সামুদ্রিক মাছ ধরার বিনোদন কেন্দ্রে ধরা মাছের ওজন লেখা আছে ৪৪ পাউন্ড। সেখানে হাঙর ও বড় মাছ বেশি ছিল। তিন দশক পর একই স্থানে পাওয়া মাছের ওজন আগের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। অর্থাত্ ২০ পাউন্ড। একই সঙ্গে বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে মাছ বড় হতে পারছে না।
ভবিষ্যত্ পরিণতির কথা না ভেবেই শিল্প-কারখানা বাড়িয়ে চলেছে মানুষ। এসব কারখানার দূষিত বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ে অপরিকল্পিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক্রমে গভীর সমুদ্রের পানির নানা রাসায়নিক পরিবর্তন, তাপমাত্রা ও অক্সিজেনের স্তরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
শিল্পযুগের বিকাশের আগে থেকে মানুষের কারণে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে বিশাল মহাসাগরের ভূমিকা অনন্য। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি, কাঠ পোড়ানোসহ বিভিন্ন দাহ্য কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে। এসব কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রায় ৩০ শতাংশই শুষে নেয় মহাসাগরগুলো। যদি কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কমানো না যায়। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ মহাসাগরের অম্লত্ব প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত সাড়ে ছয় কোটি বছরের মধ্যে (সেই ডাইনোসরের যুগে) এত দ্রুত হারে এভাবে সাগরের অম্লত্বের পরিমাণ বাড়েনি।
মহাসাগরের পানিতে অম্লের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে, তা বোঝা মুশকিল। তবে সাগরে প্রাথমিকভাবে খাদ্য উত্পাদন করে, গুরুত্বপূর্ণ এমন আণুবীক্ষণিক কিছু প্রজাতির (যেমন: সায়ানোব্যাকটেরিয়া, সবুজ শৈবালের মতো প্রজাতি যারা খাদ্যজালের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন নির্গত করে) জন্য বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান ধুয়ে-মুছে নদীতে গিয়ে পড়ে। এর সঙ্গে সার ও নর্দমার আবর্জনাও যুক্ত হয়। তার ওপর আছে উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রে বড় বড় নদীর (যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদী) মোহনায় সৃষ্টি হয়েছে একধরনের বিষাক্ত অঞ্চল। সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। কেবল গুটিকয়েক প্রজাতির প্রাণী সেখানে বেঁচে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছেন মৃত্যুপুরী (ডেড জোন)। বড় নদীর মোহনা ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল ও সাগরে এই ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, পরিবেশ দূষণে ভরা সাগরের অনেক এলাকা এখন জেলিফিশের অবাধ রাজত্ব দেখা যাচ্ছে। অফুরন্ত খাবার পেয়ে জেলিফিশ দ্রুত বেড়ে ওঠে। সাগরজলের বেশির ভাগ প্রাণী জেলিফিশের ডিম, পোনা ও অল্প বয়সী জেলিফিশ খায়। কিন্তু পরিণত বয়সে জেলিফিশেরই শিকারে পরিণত হয় এসব প্রাণী। শিকার ও শিকারির এ ধরনের পরস্পর বিপরীতমুখী ভূমিকা কেবল জলেই দেখা যায়। স্থলচরের প্রাণীর মধ্যে এমনটা দেখা যায় না বললে চলে।
জেলিফিশের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অন্যান্য প্রাণীর জন্য তা ক্রমে হুমকি হয়ে উঠছে। ছোট-বড় সামুদ্রিক প্রাণী দেদার মারা পড়ছে জেলিফিশের বিষাক্ত কাঁটা খেয়ে। মানুষও রেহাই পাচ্ছে না। ইউরোপের দেশ মোনাকোতেই কেবল ২০০৪ সালে গ্রীষ্মে জেলিফিশের হুলের আঘাতে ৪৫ হাজার সাঁতারুকে চিকিত্সা নিতে হয়েছে।
২০০৭ সালে আয়ারল্যান্ডে জেলিফিশের বিষে হাজার হাজার স্যামন মাছ মারা গেছে। এ ছাড়া ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডেও একই কারণে মাছ মরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাগরে খাবারের ঘাটতি থাকলেও জেলিফিশ সহজে মারা যায় না। এতে তারা শরীর সংকুচিত করে এবং পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। ভবিষ্যতে সাগরের পানিতে অ্যাসিডের আধিক্য থাকলেও তা জেলিফিশের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। ভবিষ্যতের সাগর হবে জেলিফিশের জগত্। সে তুলনায় মানুষের ভোগ্য মাছের সংখ্যা যাবে কমে।
বিপুল মত্স্যসম্পদসহ সাগরের মূল্যবান প্রাণী রক্ষায় শিকার কমিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সে ক্ষেত্রে বিপন্ন প্রাণীর রক্ষায় শিকার বন্ধ করে দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাঁদের পরামর্শ, বড় মাছের বদলে ছোট মাছ বেশি খেতে হবে। খামারে মাছ চাষ, বিশেষ করে চিংড়িচাষে একে তো পরিবেশের ক্ষতি, অন্যদিকে মানুষের বাসযোগ্য ভূমিরও অপচয় হয়। এর চেয়ে বরং সবজি ও লতাপাতাভুক তেলাপিয়া ও কার্পজাতীয় মাছ অনেক ভালো।
বিজ্ঞানীদের কথা, ব্যাপক হারে মাছ শিকার চলতেই থাকলে হতাশা ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে হবে মানুষকে। একই সঙ্গে কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার ও কলকারখানার বিষাক্ত অবিরাম সাগরে মিশতে থাকলে সাগরতলের পরিবেশের আরও ক্ষতি হবে। এই বিপর্যয় একদিন সাগরতলের বিশাল প্রাণীজগেক একদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউজ্উইক অবলম্বনে হাসান মাহমুদ ফয়সল।
0 comments:
Post a Comment