জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের দীর্ঘ-প্রশস্ত পথটির দুই পাশে তখন লাল-সাদা রঙে আলপনা আঁকায় ব্যস্ত শিল্পীরা। তাঁদের ঘিরে হাজারো দর্শক। হিরোকি দম্পতি শামিল হয়েছেন এতে। হিরোকি ১০ বছর এ দেশে কাজ করছেন। ভালো বাংলা বলেন। লাজুক ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘কয়েক দিন আগে দেশে গিয়ে বিয়ে করেছি। আজ চৈত্রসংক্রান্তির রাতে বন্ধুরা বউভাতের আয়োজন করেছিল। সেখান থেকেই এসেছি আলপনা আঁকা দেখতে।’
নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে এয়ারটেল ও প্রথম আলোর উদ্যোগে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে ‘আঁকব আমরা দেখবে বিশ্ব’ নামের এই আলপনা আঁকার কাজ শুরু হয়েছিল শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে। চলে নববর্ষের ভোর পর্যন্ত। রাস্তার দুই পাশে ব্রাশ দিয়ে আঁকা হচ্ছিল লাল-সাদা রঙের আলপনা। কালো রাজপথ একটু একটু করে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে নকশায়। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সী মানুষ আসে এই অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞে শামিল হতে। পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর ।
জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ছোট্ট উদ্বোধনী মঞ্চ। প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘নতুন বছরের প্রাক্কালে এই সুন্দর আলপনার মতোই পুরোনো সব জরাজীর্ণতাকে কাটিয়ে আগামী বছরটি সুন্দর হয়ে উঠবে, এই প্রত্যাশা করি।’ রাত ১১টা নাগাদ প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক দর্শকদের নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা জানান। গান শোনান শিল্পী লাইসা আহমেদ। সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য ও মনিরুজ্জামান। তাঁদের তত্ত্বাবধানে ২৫০ জনের বেশি নবীন শিল্পী পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে আলপনাটি আঁকেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন সাংসদ হাসানুল হক ইনু, আসাদুজ্জামান নূর, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও এয়ারটেলের বিপণনপ্রধান মীর নওবত আলী।
এর পরপরই এলাকায় যেন নতুন স্পন্দন জেগে ওঠে। রঙের বালতি ও তুলি হাতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শিল্পী অশোক কর্মকার ও অন্যান্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আলপনা আঁকায়। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বললেন, ‘নতুন বছরটি যেন সবারই ভালো কাটে, এই প্রত্যাশা করি।’
রাত দুইটার পর দেখা গেল মানিক মিয়া এভিনিউয়ের অর্ধেকের বেশি রাস্তাজুড়ে আলপনার বিস্তার। ফুটপাতে ছোট ছোট দলে বসে অনেকে গিটার বাজিয়ে গানে গানে মেতে আছেন। লোকজনের যাতায়াত চলছিল সারা রাত ধরেই। এমনই একজন স্থপতি ইকবাল হাবিব বললেন, ‘এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হব না, তা কী করে হয়। সে জন্য মধ্যরাতেই ছুটে এসেছি।’
ধানমন্ডি থেকে সপরিবারের এসেছেন শাহরিয়ার আলম। তাঁর স্ত্রী এবং ছোট ছেলেটি আলপনার ওপর রঙের প্রলেপ দিচ্ছে। শাহরিয়ার একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। এক ফাঁকে তিনি বললেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলপনা আঁকার খবর পেয়েই সপরিবারে ছুটে এলাম। ছেলে বড় হলে তাকে ছবি দেখিয়ে ইতিহাসের স্মরণীয় এই দিনটির কথা মনে করিয়ে দেব।’
উৎসবে শামিল হয়েছিলেন মডেল ও অভিনেতা নোবেল। তাঁর উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। শুনুন তাঁর মুখেই: ‘দেশের বাইরের কয়েক বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আলপনা আঁকার খবর দিয়ে। ওদের সঙ্গে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছি। এবার বাংলা নতুন বছরটা এত মধুর স্মৃতি দিয়ে শুরু হচ্ছে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’
তখন রাত তিনটা। দল বেঁধে বনানী থেকে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহসিনা জামান ও তাঁর বন্ধুরা; বললেন, ‘এত বড় আলপনাটি আমাদের শহরেই আঁকা হচ্ছে, আর আঁকব না, তা কী করে হয়!’
আলপনা আঁকতে ব্যস্ত চারুকলার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মনহরি সেন বলেন, ‘এত গুণী শিল্পীর সঙ্গে এত বড় আলপনা আঁকছি, এ স্মৃতি সারা জীবন অমলিন হয়ে থাকবে।’
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা দিয়ে চলা বাসের যাত্রী, আশপাশের বহুতল ভবনের বাসিন্দারা দেখেন এক অবাক করা দৃশ্য। কোনো কোনো বাসের উৎসাহী যাত্রীরা বাস দাঁড় করিয়ে একনজর দেখে নিলেন সুদীর্ঘ এই আলপনার কারুকাজ। কেউ কেউ মুঠোফোনে ছবিও তুলে নিলেন।
আলপনার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এয়ারটেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আলপনাটির আয়তন দুই লাখ বর্গফুটের বেশি। এয়ারটেলের হেড অব মার্কেটিং মীর নওবত আলী বলেন, ‘আমরা চেয়েছি এমন একটা কিছু করতে, যা বিশ্বপর্যায়ে আলোচিত হবে।’ আলপনা আঁকায় সাদা আর লাল মিলিয়ে তিন হাজার ৬০০ লিটার রং (পানি মিশ্রণের আগে) ব্যবহার করা হয়েছে।
এই আয়োজনে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল এশিয়াটিক ৩৬০ মার্কেটিং কমিউনিকেশন। সহায়তা করেছেন প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা। প্রথম আলো ডট কম, ই-প্রথম আলো, প্রথম আলো ব্লগ ও বন্ধুসভার ওয়েবসাইটে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এই আলপনা আঁকার পর্ব। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment