বিষয়টি কেউ ভালোমতো বুঝে ওঠার আগে, ঠিকমতো ঠাহর করার আগেই বাংলাদেশের মঞ্চ-টিভি-বড় পর্দার শক্তিমান এ অভিনেতা অনেকটা নিভৃতেই চলে গেলেন। অভিনেতা খলিলকে হুমায়ুন ফরীদি তাঁর লেখা সে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘খলিল ভাই শেষ কবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তা মনে করতে পারছি না। আবার যে আপনার দেখা পাব, সে কথাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না।’
বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের এই তীব্র-তীক্ষ মেধার অভিমানী মানুষটি হয়তো তাঁর ছায়ার সঙ্গেই কথা বলেছিলেন সেদিন। যে ছায়ার সঙ্গে তিনি তাঁর এ দীর্ঘ একাকিত্ব যাপন করে আসছিলেন।
ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন, যেখানে তিনি থাকতেন, সে ঘরের দরজা বন্ধই থাকত। বন্ধ ঘরে ফরীদি প্রায় প্রতীকী এক পৃথিবী রচনা করেছিলেন। যেখানে বাহ্যত কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। আজও এমনই এক বন্ধ দরজার ঘরে হারিয়ে গেলেন তিনি। দরজা খুলে তাঁর দেখা আর কেউই পাবে না। একসময়ের তুমুল আড্ডাবাজ, টগবগে এই তরুণ ৬০ বছর ডিঙিয়েছিলেন গত বছরের ২৯ মে। তাঁকে নিয়ে বন্ধু আর নিকটজনেরা যখন জন্মদিনের আয়োজন করতে চাইছিলেন তাতেও বাধা দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য বন্ধু ও স্বজনদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সে অনুষ্ঠান হয়েছিল।
মাঝেমধ্যে ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে পুরোনো স্বভাবে যখন জীবন সম্পর্কে বলতেন—সে কথা শোনাত ঠিক দর্শনের মতো। জীবনের অর্থ ফরীদির কাছে ছিল, ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাওয়া। মৃত্যুর কাছাকাছি হওয়া। শেষ পর্যন্ত যাকে ছুঁলেন তিনি। অথচ কী তুমুল জীবনই না ছিল এই মানুষটির। জীবন সম্পর্কেও তাঁর রহস্যময় এক অভিব্যক্তি ছিল। কী বিচিত্র! আলাপচারিতার ফাঁকে এমনটিও বলেছেন, ‘মানুষ আসলে বাঁচতে চায়। সবকিছুর পরও জীবন সবারই আরাধ্য। যে মানুষটা মৃত্যুপথযাত্রী তাঁরও তীব্র আকুতি থাকে বাঁচার।’
মৃত্যু সম্পর্কে স্পষ্ট, জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল তাঁর। ২০১১ সালে তাঁর লেখা চিঠিতে তিনি অভিনেতা খলিলকে লিখেছিলেন, ‘যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন আপনি, তাহলে হয়তো এই পত্র আপনার চোখে পড়বে, নতুবা মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হবে।’
প্রিয় হুমায়ুন ফরীদি, আপনি আপনার ‘খলিল ভাই’কে লেখা সে চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ‘ফিরে আসুন আমাদের মধ্যে, আরও কিছুদিন আপনাকে পেতে চাই।’
আপনি কাউকে চিঠি লেখার সুযোগ না দিলেও এমন না লেখা চিঠির বর্ণমালা আমাদের সবার বুকের ভেতরেই ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ‘ফিরে আসুন আমাদের মধ্যে, আরও কিছুদিন আপনাকে পেতে চাই।’
0 comments:
Post a Comment