তাদের মধ্যে কেউ একমঞ্চে অভিনয় করেছেন পাশাপাশি, কেউ তা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অন্য পাড়ে- দর্শকসারিতে বসে। বসন্তের দ্বিতীয় দিনের সকালে তাদের সবাই জড়ো হয়েছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, চিরতরুণ এক অভিনেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
সোমবার সকালে নিজের বাসায় মারা যান মঞ্চ-টেলিভিশন-চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, গত বছর ২৯ মে যার ৬০তম জন্মদিন উদযাপন করেছিল নাট্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহকর্মীরা। এক বছর না পেরুতেই মঙ্গলবার সকালে তাদের দাঁড়াতে হলো শেষ শ্রদ্ধার ফুল হতে, অশ্র“সজল চোখে- অনুচ্চারে বলতে হলো- বিদায় হে অভিনেতা।
ফরীদির কথা বলতে গিয়ে আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। একসময় একসঙ্গে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন তারা।
“ফরীদির মতো একজন অভিনেতা আমরা হয়তো অনেকদিন পাবো না। বিশেষ করে টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে তার মতো একজন শিল্পীর অভাব পূরণ হওয়ার নয়।”
ফরীদির তুলনা কেবল ফরীদিই- বলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
“মঞ্চে অসম্ভব দক্ষ আর প্রতিভাবান এক অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তার কোনো দুটো অভিনয় এক রকম ছিল না। বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ ছিল। চলচ্চিত্রকে তিনি এক সময় পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে এমন কিছু চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যেখানে তার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন এই অভিনয় শিল্পী। সোমবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসার বাথরুমে তাকে মৃত অবস্থায় পায় বাসার পরিচারক।
সোমবার দুপুরেই বাসভবনের সামনে প্রথম জানাজা হয়। এরপর এই অভিনেতার দুই কর্মস্থল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও এফডিসিতে নেওয়া হয় তার মরদেহ।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ফরীদির মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসার আগেই সেখানে জড়ো হয় সহকর্মী-স্বজনসহ শত শত ভক্ত। আসেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা; শিল্পী, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় এই অভিনয় শিল্পীর কফিন।
কান্নায় রুদ্ধ কণ্ঠে এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন বলেন, “ক্লাস এইটে পড়ার সময় হুমায়ুন ফরীদির একটি নাটকের ওয়ার্কশপ করেছিলাম। তাকে নিয়ে আমি কীভাবে বলবো জানি না। প্রথত তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত অভিনেতা। অভিনয় কতো ধরনের হতে পারে- তিনি তা দেখিয়ে গেছেন। তাকে আমরা হারালাম। আসলে আমরা যতোটা পাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি হারাচ্ছি।”
১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ফরীদি। পড়ালেখা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। তার অভিনয় জীবনের শুরু মঞ্চ নাটক দিয়ে। পরে অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন।
ঊনিশশ আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে কয়েকজন অভিনয় শিল্পী মঞ্চ ও টিভি নাটককে অসম্ভব জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলেন, ফরীদি ছিলেন তাদেরই একজন। ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়।
নীল নকশার সন্ধানে, দূরবীন দিয়ে দেখুন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনিসহ তার অভিনীত বহু নাটক দীর্ঘদিন মনে রাখবে এ দেশের মানুষ।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন এই শক্তিমান অভিনেতা। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একাত্তরের যিশু, সন্ত্রাস, ব্যাচেলর, জয়যাত্রা ও শ্যামলছায়া অন্যতম।
শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানো শেষে ফরীদির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে শেষ জানাজার পর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শেষ শয্যায় শোয়ানো হবে এই অভিনেতাকে, যার প্রিয় উক্তি ছিল- বাঁচো এবং বাঁচতে দাও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
0 comments:
Post a Comment