আসমা আরও বলে, মাসিক অপবিত্র এমন কথা বলে ঘরের কাজ, এমনকি বাইরেও যেতে দিত না। মাসিকের সময় ব্যবহার করা কাপড় যাতে অন্যরা দেখতে না পায়, সে জন্য আলনার পাশে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় শুকাতে হতো। সাবান দিয়ে ধুতে দিত না। এই সমস্যা একা আসমার নয়।
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন মোকাবিলায় হিমশিম খায় কিশোর-কিশোরীরা। তাদের শারীরিক সমস্যা, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে দেশের মা-বাবা-অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। এ সময় কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজন হয় নানা তথ্যের। তথ্য না পেয়ে অথবা ভুল তথ্য পেয়ে বিপদে পড়ে অনেকে। তাদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেই বললেই চলে। কিছু এনজিও কাজ করে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য।
এমনই একটি উদ্যোগ ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কর্মসূচি। কর্মসূচিতে এসে আসমা এখন জানে, বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের মাসিক হওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মাছ-মাংস খেতে অসুবিধা নেই, বরং বেশি বেশি খেতে হয়। পরিষ্কার থাকাটাও জরুরি। সে বর্তমানে রাজধানীর আদাবরে ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরী ক্লাবে সমবয়সীদের সঙ্গে এ প্রজননস্বাস্থ্য, এইচআইভি, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু জন্মগ্রহণ, যৌন-সম্পর্ক, যৌন নির্যাতন, মাদক, জেন্ডার ধারণার বিষয় নিয়ে নিয়মিত কথা বলে।
আদাবরের এ ক্লাবের আরেক সদস্য নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওয়াহিদুল তার আগের অবস্থা উল্লেখ করে বলে, বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন শারীরিক আচরণ নিয়ে সে বিব্রত হতো। সে ভয় পেত, ভাবত রোগ হলো কি না। লাজুক ছিল, কাউকে বলতে পারত না। সে বলে, ‘মন খারাপ লাগত। বন্ধুদের সঙ্গে মিশতামও না।’
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। এ সংখ্যা প্রায় চার কোটি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্যোগ সীমিত।
সরকার কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক কৌশলপত্র ২০০৬ সালে চূড়ান্ত করেছে। কৌশলপত্রে ২০১০ সালের মধ্যে সব কিশোর-কিশোরীর কাছে তাদের উপযোগী সব ধরনের তথ্য পৌঁছানো নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে লক্ষ্য অর্জনের কর্মকৌশল এখনো তৈরি হয়নি।
বয়ঃসন্ধি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যবর্তী বয়সটা বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোর। এই বয়সে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বয়ঃসন্ধিকালে মনে নানা প্রশ্ন জাগে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। মন ও মেজাজ ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়। অল্পতেই রেগে যায়। কেউ একা থাকতে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে। স্বাধীন ও স্বনির্ভর হওয়ার ইচ্ছা জাগে, নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবে এবং অন্যদের কাছ থেকে সে ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করে। না পেলে অপমান ও লজ্জাবোধ তৈরি হয়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, চঞ্চলতা, কাল্পনিক অসুখ-বিসুখে পড়া ও যৌনচিন্তার প্রবণতা আসে।
তথ্য জানাতে হবে: মিরপুরের নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দৌড়ে বাথরুমে ঢোকে। তারপর প্যান্ট পরিবর্তন করে। লজ্জা পায়। বলে, বাথরুমে যেতে যেতে প্রস্রাব হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি তার সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে তাকে কথাগুলো বলব, তা বুঝতে পারছি না।’
তবে রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের শিক্ষক রোখসানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তানদের সঙ্গে আড্ডায় যৌন-সম্পর্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়েই খোলামেলা আলোচনা হয়।’
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির প্রেসিডেন্ট এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকী প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর-কিশোরীদের কাছে তথ্য নেই। কিন্তু বাল্যবিবাহ, সন্তানধারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান জন্ম দেওয়া, অনিরাপদ যৌন-সম্পর্কে তাদের জড়িয়ে পড়া থেমে নেই। তাদের কাছে তথ্য থাকলে হয়তো তারা কম বিপথগামী হবে, বিপদে পড়লেও করণীয়টা তাদের জানা থাকবে।
মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল বলেন, আকাশসংস্কৃতির প্রভাব, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির হাতছানি, প্রাপ্তবয়স্কদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারা, মুঠোফোনে যৌন-উত্তেজক কথা বলার সুযোগ, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবাধ মেলামেশা কিশোর-কিশোরীদের জগৎকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। তাঁর মতে, সন্তানেরা কোন বয়সে মোবাইল বা দরজা বন্ধ করে কমপিউটার ব্যবহার করবে, তা অভিভাবকদেরই ঠিক করতে হবে।
ওদের অভিজ্ঞতা: ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আফসানা, ফারহানা, জাহেন বিনতে হায়দারসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলে, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা বইতে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের কিছু বিষয় আছে। তবে তারা তা যথেষ্ট মনে করে না।
নগরের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জানায়, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকেরা প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো পড়ান না। বাড়িতে পড়ে নিতে বলেন। বিদ্যালয়ে এ ধরনের আলোচনা কখনোই হয় না।
ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত সাবিনা ইয়াসমিন, রওশন আরাসহ অন্যরা জানালেন, নিজেকে জানো নামের বইতে যৌনরোগ, এইচআইভি ও কনডমের ব্যবহার বিষয়ে একটি অধ্যায় আছে। বইটি অভিভাবকদের হাতে গেলে অনেকের মনে ধারণা জন্মে যে, তাদের সন্তানদের বিপথে নেওয়া হচ্ছে। পরে বইয়ের কনডম ব্যবহারের সঠিক নিয়মের পৃষ্ঠা থেকে কনডমের ছবি বাদ দেওয়া হয়।
সরকারি উদ্যোগ: পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ইশরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে কেন গেছে, তা জানার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে সবাই। তাই সরকারের স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে কিশোর-কিশোরী কর্নার নামে একটি কর্নার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্কুল হেলথ ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক শফিউর রহমান বলেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ২৩টি স্কুল হেলথ ক্লিনিক আছে। বর্তমানে স্কুল হেলথ কর্মসূচির সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়টি যোগ করে নতুন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইউনিসেফের সহায়তায় সারা দেশে দুই হাজার ৮৬০টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব পরিচালনা করছে। এসব ক্লাবে প্রজননস্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ, যৌতুক নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব ক্লাবে কিশোর-কিশোরীরা একসঙ্গে বই পড়া ও খেলাধুলার সুযোগ পায়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেশের একাধিক শহরে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিশোর-কিশোরী কর্নারে স্বাস্থ্য তথ্য জানানোর ব্যবস্থা আছে।
পরিবর্তন হচ্ছে: বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্ল্যান বাংলাদেশের সহযোগিতায় সাতটি এনজিও দেশের ছয়টি বিভাগে ‘স্ট্রেনদেনিং এডোলেসেন্ট রিপ্রোডাকটিভ হেলথ ইন বাংলাদেশ’ নামে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপক তাহমিনা মির্জা বলেন, প্রকল্প মূল্যায়নে দেখা গেছে, এক হাজার ২২ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে মাসিকের সময় ন্যাপকিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ শতাংশ বেড়েছে। প্রকল্প শুরুর সময় ৩০ শতাংশ কিশোর শারীরিক পরিবর্তনকে রোগ ভাবত, মূল্যায়নে তা ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।
একই প্রকল্পের আওতায় এনজিও মেরী স্টোপসের একটি কেন্দ্রে তিন দিন ছেলেদের ও তিন দিন মেয়েদের পরামর্শের ব্যবস্থা আছে। আছে টেলিফোন হেল্পলাইন। গত তিন মাসে ৩৮৬ জন কিশোর-কিশোরী সেবা নিয়েছে। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment