নব্বই বছরের জীবনে জেলে বাস করব, ভাবিনি কোনো দিন। কিন্তু হায়, বাস্তবতা কখনো কখনো মানুষের ভাবনাকেও অতিক্রম করে। একাত্তরে কী করি নাই আমি! এখনো মনে পড়লে সেই সোনার যৌবনের কথাগুলো, মাথার অবশিষ্ট চুলগুলোও খাড়া হয়ে যায়! দেশ (অবশ্যই সেটা পাকিস্তান) রক্ষার জন্য হেন কোনো কাজ নাই, আমি করি নাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমি যে দলের হয়ে যুদ্ধ করেছি, তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, দেশ রক্ষা করতে পারি নাই। ধুর, এই লাইনে তো নিজেই নিজেকে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণ করছি। আসলে বয়স হয়েছে তো। তাই না চাইলেও অনেক কথা বেরিয়ে আসতে চায়। ইশ্ তখন কত দিন দিবাস্বপ্ন দেখেছি, যুদ্ধে জয়ী হব, পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব, এ দেশের বিদ্রোহীদের নিকাশ করে ছাড়ব। মানুষের সব খায়েশ সব সময় পূরণ হয় না, এর পেছনেও কোনো কারণ থাকে। তবে আমিও হাল ছাড়িনি। যুদ্ধে পারিনি তো কী হয়েছে? রাজনীতি করে সেটা অর্জন করব। যাদের ভাষায় আমি যুদ্ধাপরাধী, তাদের সঙ্গেই আমি এ দেশে রাজনীতি করেছি, নির্বাচন করেছি। আমার দলের লোকেরা তাদের গাড়িতে এ দেশের পতাকা উড়িয়েছে। আমার দলের লোক কিছু কিছু আসনে জয়ীও হয়েছে। আমি আবার স্বপ্ন দেখি সোনার পাকিস্তানের! আহা! কী মধুর যুদ্ধের সেই দিনগুলি! কিন্তু গত নির্বাচন সবকিছু ওলটপালট করে দিল! তবে আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে পতপত করে।
এরশাদ সাহেব একানব্বই সালে জেলে গিয়ে একটা বরইগাছ লাগিয়েছিলেন, বেগম জিয়ার জন্য। যাতে আরেক দিন বেগম জিয়াও জেলে গিয়ে সেই গাছের বরই খেতে পারেন। মিসেস জিয়ার বোধ হয় টকের প্রতি আলাদা একটু টান রয়েছে। আমারও কি কোনো গাছ লাগানো উচিত? বুঝতে পারছি না। আরেকটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারি না। এই যে আমরা দিনের পর দিন বিএনপির সঙ্গে লেগে আছি এবং অনেকেই এখন আমাদের দুই দলকে একত্রে বলছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ন্যাশনাল পার্টি। জিয়াউর রহমান সাহেব যদি সত্যিকারের স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন, তার মানে তিনি তৎকালীন একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। আর তখন আমরা ছিলাম তাঁর বিরোধী দলের সক্রিয় যোদ্ধা। অর্থাৎ, আমরা ছিলাম পরস্পর শত্রু! অথচ এখন কত সুন্দর শত্রুর স্ত্রীর সঙ্গে আমরা একই মঞ্চে কাজ করছি; উদ্দেশ্যটাও যে অভিন্ন নয় সেটা কে বঝুবে! আর তিনিও কত সুন্দর স্বামীর শত্রুর সঙ্গে বসে কাজ করছেন। একেই বলে তকদিরের খেল। এসব ভাবলে জেলের সেলেও দিনগুলো আনন্দে ভরে ওঠে, চোখ দিয়ে আমার কত স্বপ্ন চিকচিক করে। আমি আসলে ভেবে দেখলাম, ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তখন মানুষ আসলে কে শত্রু আর কে মিত্র এসব ভাবে না। ম্যাডামের উদ্দেশ্য ক্ষমতা, আমাদেরও উদ্দেশ্য ক্ষমতা। ক্ষমতায় গিয়ে ওনার লক্ষ্য জিয়াউর রহমান, প্রতিষ্ঠা করা, আর আমার স্বপ্ন যে কী হতে পারে, তা অন্তত এ দেশের মাটি জানে। কারণ, দেশ নাকি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের মা! আমি অবশ্য মেয়ে দেখলেই মা ভাবতে পারি না। তাদের মা ভাবার কী আছে?
একটাই শুধু হতাশা! শেষ বয়সে এসে জেলে ঢুকে জীবনীতেও জেল ঢুকে গেল। এই জীবনী ভবিষ্যতে কত অনুসারী, গুণগ্রাহী পড়বে। যতটুকু জানি, এসব ক্ষেত্রে জীবনীতে জেল খুব ভালো কাজ দেয়। ত্যাগী ত্যাগী একটা ভাব চলে আসে। তবে জেলে ঢুকেই একটা হুইলচেয়ার ম্যানেজ করে ফেললাম। এনেছিস যখন একটু খাতির-যত্নও কর। সারা জীবন তো খাতির-যত্ন পেয়ে পেয়ে কাটিয়েছি। জীবনের এই শেষ কটা দিনও ওভাবেই কাটাই।
খুব ঘুম আসতেছে। ঘুম আসলেই খালি মনে হয় ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে...’ এই কবিতাটি।
কাল্পনিক এই দিনলিপির অনুলিখন করেছেন তাওহিদ মিলটন prothom-alo
0 comments:
Post a Comment