আনন্দ অনেকভাবেই আসতে পারে মানবজীবনে। কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা যুদ্ধজয়ের আনন্দ তুলনারহিত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার স্রোত, সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর বুকের উষ্ণ রক্তে রাঙিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে বাঙালির বুকে বেদনাও করাঘাত করে যায়। সে কারণেই এ বিজয় মহৎ, মহান। আজ ৪০ বছর পূর্ণ হলো মহান বিজয়ের।
এ দীর্ঘ চার দশকে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলন এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পাশাপাশি দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা আর প্রবল বন্যা, সিডর, ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে ধীরগতির। তদুপরি হতোদ্যম হয়নি এ দেশের মানুষ। বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে ইতিহাসের দায়মোচনের লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া। ঘরে এসেছে নোবেল পুরস্কার। হার না-মানা বাঙালি এগোচ্ছে লাল-সবুজ পতাকা উঁচিয়ে।
১৯৭১-এ চূড়ান্ত বিজয় এলেও বাঙালির এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আত্মচেতনায় দৃপ্ত দেশবাসী অগ্রবর্তী হয়েছিল স্বাধিকারের আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের পরিণতি গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। উত্তাল সারা বাংলা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকেরা সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে রক্তের বন্যায় বাঙালিদের ভাসিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য নীলনকশায় মেতে ওঠে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বাঙালিদের বললেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে। বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’।
পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে ওঠে। দেশমাতৃকার বীর সন্তানেরা সামান্য অস্ত্রপাতি আর বুকভরা সাহস নিয়ে পৃথিবীর দুর্ধর্ষ বাহিনীটির হামলা ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। মার্চ থেকে ডিসেম্বর—নয় মাসের সংগ্রামে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন করে আঁকা হলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমারেখা। বাঙালির রক্তস্নাত মাতৃভূমি ‘বাংলাদেশ’।
আজ কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের পরাধীনতার গ্লানিমোচনে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে অগণিত মানুষ নিবেদন করবে পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ছাড়াও সারা দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশ নেবে বিজয় উৎসবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানাগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে এবং বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
বাণী: মহান বিজয় দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, আগামী দিনের বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না এবং সবার জন্য সম্ভাবনার দুয়ার থাকবে অবারিত।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কর্মসূচি: প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে রাজধানীতে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে আছে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এ ছাড়া সকালে তেজগাঁও জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী এতে সালাম গ্রহণ করবেন। প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment