জরিপে দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই হূদরোগের মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন। বেশ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিচালিত ওই জরিপে দেখা যায়, এই ৭৮ শতাংশ মানুষের হূদযন্ত্র তাদের বয়সের চেয়ে বেশি বয়সী হয়ে গেছে।
‘বয়সের চেয়ে বেশি বয়সী হূদযন্ত্র’—এ তথ্যটি একটু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। বিষয়টি খোলাসা করলে এমন দাঁড়ায়—একজনের বয়স যদি ৩২ হয়, তাহলে তাঁর হূদযন্ত্র ৩৯ বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি বয়সীদের মতো কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে তাঁর হূদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে একটি ছোট্ট গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। দিল্লির বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ৩২ বছর বয়সী এক তরুণ একদিন এক অলস রোববারে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে করতে নিজের সম্পর্কে ভয়ংকর এক তথ্য আবিষ্কার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের একপর্যায়ে ‘গুগল সার্চ’ আমাদের জন্য সাধারণ এক বিষয়। সেই তরুণ গুগলে সার্চ অপশনে লিখেছিলেন ‘হার্ট’। ‘হার্ট’ শব্দটি দিয়ে সার্চ করার কারণেই কি না, তিনি খুঁজে পেলেন একটি নতুন ধরনের শিরোনাম—‘হাউ ওল্ডার ইয়োর হার্ট ইজ’। কৌতূহল নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তিনি পান একটি প্রশ্নপত্র। সেখানে বেশ কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তরদাতার ‘হূদয়ের’ বয়স সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে। সেই প্রশ্নপত্র পূরণ করে তিনি দেখলেন ৩২ বছর বয়সেই তাঁর হূদযন্ত্র কাজ করছে ৪২ বছর বয়সীর মতো। সেই সঙ্গে তাঁর হূিপণ্ড রয়েছে হূদরোগের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে।
জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ই বলা যায় এই ৩২—৩৯ বছর বয়সকে। অথচ চিকিত্সা বিজ্ঞানের গবেষণা বলছেন, এ সময়টিতেই যুবকেরা পড়েন অসুস্থতার ঝুঁকিতে। আর সেই অসুস্থতাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন ৩০—৩৯ বছর বয়সী তরুণীদের চেয়ে যুবকেরা অধিকমাত্রায় হূদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন। যুবকদের মধ্যে যে ওয়াই ক্রোমোজোমের উপস্থিতি থাকে, সেই ক্রোমোজোমই তাঁর হূদরোগের ঝুঁকিটা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। সেই গবেষণায় আরও দেখা যায়, তরুণীদের শরীরে রয়েছে এস্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন, যা অল্প বয়সে হূদরোগের হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করে।
তবে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশের তরুণ ও যুবকেরা অধিকমাত্রায় হূদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন। ইউরোপে যেখানে চল্লিশের নিচে হূদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ৫.৬ শতাংশ, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে এ হার ১২ শতাংশ। এর কারণ, পশ্চিমাদের তুলনায় ভারতীয়দের হূদযন্ত্র অনেকটা আলাদা। পশ্চিমাদের করোনারি আর্টারি কিছুটা চওড়া। ভারতীয়দের করোনারি আর্টারি অনেকটাই সংকীর্ণ। ভারতের বিখ্যাত হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবি শেঠি পুরো বলেন, ইদানীং তাঁর কাছে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে যে রোগীরা আসেন তাঁদের বেশির ভাগের বয়সই ৩০—৩৯ বছর বয়সের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘আমার অবাক লাগে যখন দেখি, এদের হূদরোগের যে অবস্থা থাকে, সেই অবস্থা সাধারণত বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে হওয়ার কথা।’
ডা. শেঠিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কি কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের তরুণেরা অধিকমাত্রায় হূদরোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তিনি বলেন, পশ্চিমাদের তুলনায় এমনিতেই ভারতীয়দের হূদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার তিনগুণ বেশি। তার ওপর আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের ডায়াবেটিক রোগের ঝুঁকিও বেশি। তা ছাড়া অনেকেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারে অভ্যস্ত। খাওয়া-দাওয়ায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধিক তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, রান্নায় মসলার ব্যবহার—এগুলো হূদরোগের বড় কারণ। ধূমপানের ব্যাপারটি তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অতিমাত্রায় অ্যালকোহল পানও বড় কারণ।
হূদযন্ত্রের বয়স সম্পর্কে দিল্লির প্রখ্যাত হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নরেশ ত্রিহান বলেন, একজন মানুষের বয়সের তুলনায় তার হূদয়ের বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়াটা বিজ্ঞানসম্মত। তাঁর মতে, ‘এটা নির্ভর করে একজন মানুষের জীবনাচারের ওপর। আপনি শরীরের ওপর যদি ৩০ বছর বয়সেই বেশি অত্যাচার করে ফেলেন, সে ক্ষেত্রে আপনার হূদয় “বুড়ো” হয়ে যেতে বাধ্য।’
পুরো ব্যাপারটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ৫০ বছর বয়সের একজন ব্যক্তির হূিপণ্ডও অনেক বেশি কার্যক্ষম হতে পারে। যদি তিনি নিয়ন্ত্রিত ও সংযমী জীবন-যাপন করেন, ধূমপান না করেন, সময়মতো ঘুম, শরীরচর্চা ইত্যাদি করেন। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে মানলে পঞ্চাশেও তাঁর হূিপণ্ড ৩০ বছর বয়সী হূিপণ্ডের মতো কর্মক্ষম থাকতে পারে। উল্টোটা করলে আটাশেই আপনি হূদরোগের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে শহুরে তরুণদের ৬০ শতাংশেরই রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা অনেক বেশি। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি এসে তাদের কায়িক পরিশ্রম কমিয়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। এরা হাঁটে না। কম্পিউটারের সামনে বসে দিন কাটিয়ে দেয়। ধূমপানে বেশি আসক্ত। ইদানীং অ্যালকোহল গ্রহণের মাত্রা বেড়ে গেছে অধিক হারে।
ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের হূদরোগ বিশেষজ্ঞ শ্রীনাথ রেড্ডি বলেন, একজন তরুণ এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারেন নানাভাবে। ধূমপায়ী হলে তাঁর প্রথম কাজ হবে, ধূমপান সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দেওয়া। তেল-চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। আর কমিয়ে ফেলতে হবে চা-কফি পান। খাবারে লবণের পরিমাণ কোনো অবস্থাতেই দিনে ৫-৬ গ্রামের বেশি হবে না।
0 comments:
Post a Comment