জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও আজকের সাংসদ মমতাজ। তাঁর চলার পথটি মসৃণ ছিল না। পরিশ্রম, সংগ্রাম করেই আজকের এই অবস্থানে আসা। শুধু গান নয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন তিনি। গড়েছেন হাসপাতাল। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি আবার বিয়ে করেছেন। মমতাজ কী বলেন এসব নিয়ে? তাঁর সময় পাওয়া গেল রোববার বিকেল চারটায়। নিউ ডিওএইচএসে, মমতাজের বাসায়। গান বাজছে। মমতাজের নয়। বাসার ভেতরে বেশ একটা উৎসব-উৎসব ভাব। হেঁশেলে রান্না হচ্ছে। তার সুঘ্রাণ এসে লাগছে নাকে। বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলছে। ওপরতলা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে এলেন মমতাজ। তাঁর চেহারা কিছুটা মলিন। বাড়ির উৎসব-উৎসব আবহের কোনো ছোঁয়া তেমন নেই। মানসিক চাপ ছায়া ফেলেছে তাঁর চোখে-মুখে। পরনে সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ। গান বন্ধ হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর হাতের রেকর্ডারটা তাঁর চেয়ারের পাশে রাখি। রেকর্ডারের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন তিনি। এরপর শুরু হলো আমাদের কথাবার্তা।
কয়েকদিন ধরেই বন্ধ পাচ্ছি আপনার ফোনটা...
১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান ছিল। বিমান থেকে নামার পর দেখি হাতের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আর খুলতে পারিনি। পরদিন কিন্তু ফোনটা খোলা ছিল। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ফোনটা একেবারেই বন্ধ করে দিই।
কেন, বলুন তো...
নানাজনের কাছ থেকে সারাদিন ধরে অসংখ্য ফোন আসছিল। নানা ধরনের প্রশ্ন করছিল তারা। সেসব প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্যই ফোনটা বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত নিই।
কী ধরনের প্রশ্ন করছিলেন সবাই?
সবাই জানতে চাইছিল, আমি বিয়ে করেছি কিনা, কবে করেছি, রমজান আলীকে ছেড়ে দিয়েছি কিনা। বারবার একই জবাব দিতে ভালো লাগছিল না।
আসলে ব্যাপারটা কী?
এটা একটা গুজব।
মমতাজ চক্ষু হাসপাতাল নিয়ে কিছু বলুন। হাসপাতালের শুরুটা কবে থেকে?
২০০৪ সালের ৭ জানুয়ারি। মানিকগঞ্জ শহরে জয়রা রোডে।
হাসপাতালের দেখাশোনার দায়িত্বে তখন কে ছিলেন?
রমজান আলীর সেজোভাই দেলোয়ার হোসেন। তাঁর ঠিকাদারি ব্যবসা আছে। তাঁর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের আরও কয়েকজন ছিলেন। সব চিকিৎসকই তাঁদের ওপর বিরক্ত ছিলেন। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তাদের সরিয়ে দিই। সে সময় ডা. এ এস এম মঈন হাসান (চঞ্চল) হাসপাতালে যোগ দেন। তখন অনেক দুর্নীতি আর অনিয়ম ধরা পড়ে। হাসপাতালের তিনজন চিকিৎসক ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন নার্সসহ আরও অনেকে। হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর প্রথম দুই বছরে আমি একটি টাকার মুখও দেখিনি। উল্টো প্রতি মাসে আমাকে বেতন ও অন্যান্য খরচ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হত।
হাসপাতালের কোনো আয় ছিল না?
ছিল। প্রত্যেক রোগী টিকিট কেনা বাবদ ২০ টাকা দিতেন। অস্ত্রোপচারের জন্য নূন্যতম একটা টাকা নেওয়া হত। এ ছাড়া ছিল চশমা আর ওষুধের দোকান। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল দুর্নীতি। আমি কিন্তু বিশ্বাস করেই তাদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম, হাসপাতালের নিজস্ব আয় দিয়েই একদিন হাসপাতালের সব কাজ চলবে। ডা. মঈন আসার পর আমি অনেক কিছু বুঝতে পারলাম। শেষে পুরোনো লোকজন বাদ দিয়ে একজন পরিচালক নিয়োগ দিই। হাসপাতালটিকে দুর্নীতিমুক্ত করে স্বাবলম্বী করার জন্য ডা. মঈনকেও কিছু বিশেষ দায়িত্ব দিই।
রমজান আলীর সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়েছিল কবে?
২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এই সংসারে আমাদের দুই মেয়ে—রুহানী ও রোজ।
কেমন ছিল আপনাদের সংসার?
রমজানের আগের স্ত্রী ছিলেন। ওই সংসারে তার সন্তান আছে। রমজান ছিল আমার গানের খুবই অনুরাগী। নিজেকে সবার সামনে মেলে ধরার জন্য আমি তখন প্রথম স্বামীর ঘর ছেড়ে এসেছি। বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আর আমার ছিল না। কিন্তু রমজান পিছু ছাড়ল না। যে কোনো উপায়েই হোক না কেন, আমাকে ও বিয়ে করবেই। শেষ পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। বাসায় হুজুর ডেকে আমরা বিয়ে করি।
তিনি তো তখন এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। বিয়ের সময় সে রকম কোনো ভাবনা কি কাজ করেছিল?
এটা ঠিক, সে তখন মানিকগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান। কিন্তু ও রকম ভাবনা আমার ছিল না। কারণ ২০০০ সাল পর্যন্ত আমার চারশ অ্যালবাম বেরিয়ে গেছে। রীতিমতো জনপ্রিয় শিল্পী।
আপনার প্রথম স্বামী তো ছিলেন রশীদ সরকার।
হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন আমার গানের গুরু। তার সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন সেটাকে বিয়ে বলে মনে হয়নি। তাঁর বয়স তখন ৫০ বছর, আমার ১৫। বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে। বিয়ের দুই বছর পর আমার একটা ছেলে হয়। নাম মেহেদী হাসান। তার বয়স আজ (২ অক্টোবর) ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে। বাক্প্রতিবন্ধী। মূক ও বধির স্কুলে পড়াশোনা করছে।
রশীদ সরকার তো ছিলেন খুবই উদাসীন। ফকির বা পাগল ধরনের মানুষ। তাঁরও আলাদা সংসার ছিল। আমাদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কটাই ছিল বড়। আমাদের সম্পর্ক ছিল ২০০০ সাল পর্যন্ত। তিনি এখন বেঁচে নেই। তাঁর অনেক ভক্ত ছিল। তিনি চাইতেন, দোতারা আর একতারা দিয়ে শুধু বাউল গান করব। চাইতেন, তাঁর স্ত্রী হিসেবে বাড়িতে থেকে ভক্তদের আমি দেখাশোনা করব। কিন্তু আমি তখন আমার গানকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। গানের সঙ্গে আমি আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে চাইতাম। এ ব্যাপারটা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন, আমি বৈঠকী পালাগান করব। গান করব শুধু আত্মার শান্তির জন্য। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য না। অথচ আমি সে সময়ই আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গান গাইতে শুরু করেছি।
আপনি তো একসময় অনেক পালাগান করেছেন।
বর্ষাকাল ছাড়া ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এমন রাত খুব কমই ছিল, যখন আমি বাড়িতে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। প্রায় প্রতি রাতে দেশের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে আমি পালাগান করেছি।
রশীদ সরকারের সঙ্গে কি সম্পর্ক শেষ?
তিনি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার মিলছে না, তুমি তোমার মতো থাকো, তোমার মতো চলো।’ এই আর কি!
রমজান আলীর সঙ্গে আপনার মনান্তরের সূত্রপাত কীভাবে হলো?
ওর তো আগের সংসার ছিল। সে কখনোই আমাকে তার বাড়িতে নিতে পারেনি। আমি তার কাছ থেকে যে পারিবারিক স্বীকৃতি চেয়েছিলাম, তা পাইনি। এ ব্যাপারে সে কখনো কিছু বলেওনি। আমাদের বয়সেরও পার্থক্য ছিল। বিয়ের কিছুদিন পর আমার টাকা ও সম্পদের দিকে তার নজর পড়ে। বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে সে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, কখনো ফেরত দেয়নি। আমি রমজানের কাছে টাকা বা সম্পদ কিছুই চাইনি; চেয়েছি একটু সম্মান আর স্বীকৃতি, সেটাও পাইনি।
আপনারা আলাদা হয়ে গেলেন কবে থেকে?
২০০৬ সালে, নিউ ডিওএইচএসের এই বাসায় ওঠার পর থেকে। তখন আমার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। হাসপাতাল থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল এসেছিল। তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলাম, পাইনি। এরপর টাকা পয়সা নিয়ে ও একটা ঝামেলা করেছিল। কিছু দিন পর আমিই ওকে বাসায় ডেকে নিয়ে আসি। কারণ ও বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে আমাদের বিয়ের ভবিষ্যতের ব্যাপারে জানতে চাইছিল। ও চাইছিল, আমিই যেন ওকে তালাক দিই। আমরা যখন বিয়ে করি, তখন তো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দুনিয়ার কোনো মানুষ পাশে ছিল না। এখন কেন অন্যেরা এসে নাক গলাবে? রমজান বাসায় এসেছিল, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষেরা ছাড়া কেউই জানত না যে, ২০০৬ সাল থেকে আমরা একেবারে আলাদা জীবনযাপন করছি।
আপনি কি আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
তিন দিন আগে আমি রমজানকে তালাক দিয়েছি। আজ (২ অক্টোবর) সেই কাগজ ডাকযোগে তার হাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আমাকে হেয় করে যেসব কথা ও বলেছে, এর পরে আর ওর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব?
আপনাদের সংসারে তো দুটি মেয়ে আছে। ওদের কথা কিছু ভেবেছেন?
ওরা সব সময় আমার কাছেই ছিল, বাবার কাছে কখনো যায়নি। ওরা আমার কাছেই থাকবে।
ডা. মঈনকে আপনি হাসপাতালের ভালো-মন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনি কবে থেকে অনুভব করলেন যে, আপনার পাশে তার থাকাটা খুব প্রয়োজন?
হাসপাতালের দুর্নীতি ও অনিয়মগুলো সে শোধরাতে শুরু করল, আমার এই হাসপাতাল উন্নতির জন্য নানা প্রচেষ্টা নিল, কাজের ব্যাপারে তার সততা ও যোগ্যতাও দেখেছি—সব মিলিয়ে তার ব্যাপারে আমি মুগ্ধ হয়েছি। সাংসদ হওয়ার পর আমার পাশে কিছু ভালো মানুষের প্রয়োজন আমি খুব অনুভব করেছিলাম—যারা আমাকে সহযোগিতা করবে, ঠিকভাবে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। সে রকম কিছু ভালো মানুষ আমি পেয়েছি। ডা. মঈন তাদের একজন।
আপনারা কি বিয়ে করেছেন?
না, না। তার সঙ্গে আমার শুধুই কাজের সম্পর্ক। আমরা বিয়ে করিনি। যদি তা-ই করতাম, তাহলে রমজানের সঙ্গে আগে বিবাহবিচ্ছেদটা সেরে নিতাম। আমি একজন শিল্পী, আমি একজন সাংসদ—এই জ্ঞানটুকু আমার আছে।
শুনেছি, আপনি যখন বিদেশে গান গাইতে যান, তখন তো উনি ছিলেন?
দুবাইতে আমরা একবার একসঙ্গে গিয়েছিলাম, চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানে। তার লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। দুবাই পর্যন্ত আমার সঙ্গে গিয়েছিল। তাছাড়া বিদেশে আমার যেসব ট্যুর হয়, সেগুলোর কাগজপত্র তৈরি করা, নিয়মিত মেইল দেখা—এসব কাজে ডা. মঈন আমাকে সহযোগিতা করে। মানুষ যেভাবে বলছে, সেরকম কিছু নয়।
সামনে কি বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?
ভাগ্যের কথা তো বলতে পারব না। তবে বিয়ে নিয়ে জীবনে আঘাত পেয়েছি। আর কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়।
ডা. মঈনের কথা কিছু ভেবেছেন?
ও আমার ভালো সহকর্মী, ভালো বন্ধু। আমার পাশে থেকে আমাকে সহযোগিতা করছে।
ভবিষ্যতে যদি বিয়ের কথা ভাবেন, সে ক্ষেত্রে কি সুনির্দিষ্ট কারো কথা ভাববেন?
বিয়ে যদি আদৌ করি, তাহলে হয়তো ডা. মঈনকেই করব। আমার চরম দুর্দিনে ওকে আমার পাশে পেয়েছি। ওর ওপর আমি নির্ভর করতে পারি। বিয়ে যদি করি, সবাইকে জানিয়েই করব। অভিভাবক হিসেবে আমার মা এখনো আছেন । তার সঙ্গে কথা বলে যেটা ভালো হয় সেটাই করব।
মমতাজের বাসায় ততক্ষণে মেহমান আসতে শুরু করেছেন। তাঁর ছেলে মেহেদী হাসানের জন্মদিন। মমতাজ জানালেন, পূজার ছুটিতে মেয়েদের নিয়ে ৩ অক্টোবর দুপুরে তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ফেরার কথা ৬ অক্টোবর। দেশে এসেই তিনি ফিরে যাবেন মমতাজ চক্ষু হাসপাতালে, তাঁর স্বপ্নের জায়গায়।
Prothom-alo
0 comments:
Post a Comment