আজ শোককে শক্তিতে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ নিচ্ছে পুরো জাতি। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির নীড় গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। এদেশের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ আজ নতুন করে শপথ নেবে যাতে এদেশের মাটিতে আর কোনো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের স্থান না হয়। আর যেন কোনো ঘাতক এ জাতির কোনো সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিতে না পারে। আর যেন কোনো ঘাতকের জন্ম না হতে পারে সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এমন শপথের মধ্যদিয়ে দিনটি পালন করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনও এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। জাতীয় শোক দিবসে সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশি দূতাবাসগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জ আদালতের সেরেস্তাদার বাবা শেখ লুৎফর রহমানের ৪ কন্যা ও ২ পুত্রের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। তিনি ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে ২ বছর লেখাপড়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়। চোখের অপারেশনের কারণে ১৯৩৪ সালে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন। এর ৪ বছর পর ১৯৩৮ সালে চোখের সমস্যা ঠিক হলে তিনি আবার স্কুলে ভর্তি হন। ওই বছর তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে বিয়ে করেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রাবস্থায় ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার পর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। তখন থেকেই তিনি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার আপামর জনগণের নেতায় পরিণত হন। ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জেলে গিয়েছেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি তৈরি করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কাজে মনোযোগ দেয়ার কারণে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে ’৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের আপামর জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। ’৭২ সালে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যখন দেশ গঠনের নতুন সংগ্রাম শুরু করেন তখন পরাজিত শক্তি তাকে সমূলে বিনাশের চক্রান্ত করে। পরাশক্তির সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছিল। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকাে র শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, জ্যেষ্ঠ পুত্র বাংলাদেশ ফুটবলের আধুনিকতার স্রষ্টা আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র সেনাবাহিনীর গর্বিত সেনানি, মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। দেশের বাইরে থাকার কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর ২ কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুকে হতার পর বিগত ৩৪টি বছর বাঙালির ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যায়নি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে বছর ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালের ২২ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বাতিল করে এবং ২৯ জুলাই এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করে। একই বছর ৩ আগস্ট সরকারের নির্বাহী আদেশে ওই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হয়। এরপর থেকে অন্য কর্মসূচির সঙ্গে প্রতীকী প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এই দিনে সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল পালন করে আসছিল।
২০০৭ সালের ৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মোজাম্মেল হক, মোল্লা আবু কায়সার ও এম এ মালেক ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বাতিল করে জারি করা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রজ্ঞাপন বাতিলের আর্জি জানিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন। ওই রিটের নিষ্পত্তি করে ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্ট জোট সরকারের নির্বাহী আদেশ বাতিল এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বহাল রাখেন। অন্যদিকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ৭ বছর অপেক্ষার পর সুপ্রিম কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচার কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায়ে ১২ খুনির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। এদের মধ্যে আটক ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। সবকিছু মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাওয়ার একুশ শতকের সংগ্রামের সূচনালগ্নে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাপক আয়োজনে যথাযোগ্য মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে জাতীয় শোক দিবস। এ দিনে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার নতুন করে শপথ ঘোষিত হচ্ছে। ‘দেশ থেকে দুর্নীতি-অনাচার ও সব অবিচার দূর হোক, গণতন্ত্রের জয় হোক।’
জাতীয় শোক দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে সারাদেশে সভা-সেমিনার, আলোকচিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবন ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সব সাংগঠনিক শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন, সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক গার্ড অব অনার প্রদান, সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, সকাল সাড়ে ৭টায় বনানীস্থ কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত এবং বাদ জোহর টুঙ্গিপাড়ায় মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল। বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গনে মহিলা লীগের উদ্যোগে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, বিকাল ৪টায় মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে প্রার্থনা সভা এবং বাদ আসর দেশের সব ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় মিলাদ মাহফিল ও ইফতার। এছাড়া আগামীকাল বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৬তম শাহাদতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পালনের জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থাগুলোর সবস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সব শাখার নেতৃবৃন্দকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে দিবসটি স্মরণ ও পালনের অনুরোধ করেছেন তিনি..
0 comments:
Post a Comment