দেশের অর্থনীতিকেই যে শুধু চাঙা করেছেন তাঁরা সবটুকু শ্রম উজাড় করে দিয়ে এমন নয়, বরং এই অল্প আয়ের মেয়েদের ছোটখাটো ফ্যাশনকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে বাজার। সস্তার লিপস্টিক, ছোট একটা আই পেনসিল, মিনিপ্যাক শ্যাম্পু, ১৫ টাকায় কেনা ছোট পার্স, ১০ টাকায় কেনা নূপুর। চোখ ভেসে যায়। নূপুর পরে ছুটে চলে যে জীবন, সে জীবন শুধু ছুটে চলার জন্য নয়, একটু সাধের-শখের ছোঁয়াও বুঝি ধরে রাখতে চায় একঘেয়ে সেলাইজীবনে। সেই জীবনকে জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। থামিয়ে দিয়েছে আমাদের লোভ, শ্রমিকের প্রতি দায়হীন জাতীয় আয় বৃদ্ধির সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। এর নাম নিও লিবারালিজম।
যে করেই হোক, প্রবৃদ্ধি বাড়ল কি না, সেটিই বিবেচ্য। তাঁর নিরাপত্তা দেখার দায় নেই মালিকের। কারণ, রাষ্ট্র আশ্বস্ত যে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য পোশাক কারখানার মালিকদের মানুষ মারা অনিয়মগুলো মেনেই নেওয়া যায়। দেয়ালে ফাটল দেখা গেলে একই দালানের অফিস বন্ধ করতে হয়, কিন্তু শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ দালানে কাজে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা যায়। নূপুর পরা এই নিথর পা বুঝি জবাব দিয়ে যায় আমাদের লোভের, পাপের, উদাসীনতার, জবাবদিহিহীন খুনে রাষ্ট্রকে; আমাদের পোশাকি সভ্যতা আর মুনাফার জয়োল্লাসের মুখে।
২.
দুজন শ্রমিক মা এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। অর্থাৎ, গরিব দুই মা সন্তান জন্ম দেওয়ার শেষ পর্যায়েও এসেছিলেন কাজে। কতটা অসহায় হলে এই আসন্ন অবস্থায় একজন মা কাজে আসতে বাধ্য হন! অথচ আমাদের আইনে রয়েছে নিরাপদ মাতৃত্বকালীন ছুটি। বহুবার শুনেছি, পোশাক কারখানায় এসব আইনের তোয়াক্কা করা হয় না। প্রসূতি মায়েরা ছুটি চাইলে বিদায় করে দেওয়া হয় কারখানা থেকে।
বিজিএমইএ বা রাষ্ট্র কোনো তদন্ত করেনি এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে, ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক। মানবতার ধ্বজাধারী ক্রেতাদেশগুলো তাদের চুক্তি বাতিল করেনি। কোনো সাচ্চা ট্রেড ইউনিয়ন নেই কারখানায় ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য কাজের পরিবেশ কিংবা প্রসূতি মায়ের ছুটির বিষয়ে একটি কথা বলার জন্য। মালিকপক্ষ সব সময়ই এসব অভিযোগ অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সন্তান জন্ম দিয়ে দুই নারী শ্রমিক জানিয়ে দিলেন আমাদের, তাঁরা প্রসূতি ছুটি পান না।
আসলে শ্রমিকও হতে পারেননি তাঁরা, কেবল মজুরি-দাস হিসেবেই আটকে আছে তাঁদের জীবন। এসব আসন্ন-প্রসূতি মজুরি-দাস ফাটল দেখে কারখানায় যেতে চাননি, কিন্তু ‘বসরা’ লাঠি নিয়ে তাড়া করলে তাঁরা ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ বক্তব্য চিকিৎসাধীন এক শ্রমিকের।
৩.
হতবাক আমি, যখন স্তব্ধতার আড়মোড়া ভেঙে লিখছি এই লেখা, তখন আমার ফেসবুক সয়লাব উদ্ধারকারীদের সাহায্য চেয়ে পাঠানো জিনিসের তালিকায়। তাঁরা চাইছেন ছোট শাবল, গাঁইতি, পানির ছোট ছোট বোতল, অক্সিজেন মাস্ক, ওষুধ এবং সবচেয়ে বেশি চেয়েছেন ছোট টর্চলাইট। নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসা উদ্ধারকারীরা আরও চাইছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাইড্রোলিক রড কাটার, ড্রিল মেশিন ও সার্জিক্যাল মাস্ক।
৪২ বছরেও নাকি এসব ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আটকে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করার মতো প্রযুক্তি কিংবা দক্ষতা নেই আমাদের দেশে। ওদিকে বিজিএমইএর সাবেক-বর্তমান নেতারা বসেছেন টক শোতে। আর রাষ্ট্র ফের জাতীয় শোক দিবস আর জাতীয় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে, ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞকে সহনীয় করে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যেমন চালিয়েছিল তাজরীন ফ্যাশনসে সরকারি হিসাবে ১১১ জনের মৃত্যুর পর। উদ্ধারকাজে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সীমাহীন। ২৪ এপ্রিল সকালে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল, অথচ ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, আনসার আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজে যোগ দিয়েছেন বেলা দুইটার পর। সাধারণ মানুষ উদ্ধারকাজে নেমেছেন এর আগেই। গণজাগরণ মঞ্চে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছেন রক্ত দিতে। এই মানবিকতার প্রতি ভরসা রেখেই বলি, রাষ্ট্রীয় দায় ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র কবে সেই দায়-দক্ষতা অর্জন করবে আর?
৪.
মিরপুরের সারাখা, মাইক্রো, তেজগাঁওয়ের ফিনিক্স, আশুলিয়ার স্পেকট্রাম, তাজরীন, সাভারের রানা প্লাজা—এগুলো একেকটি মৃত্যুকূপের নাম। যে মৃত্যুকূপের মালিকেরা শত শত শ্রমিক হত্যা করে নিরাপদে আছেন। বিল্ডিং কোডকে বুড়ো আঙুল দেখানো শ্রমিক হত্যাকারী এসব মৃত্যুকূপের মালিকদের ইনস্যুরেন্স পাকা। দলনির্বিশেষে সব সরকারই তাঁদের জামিনদার। ইতিমধ্যে বিতর্ক উঠে এসেছে, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা স্থানীয় যুবলীগের নেতা কি না।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সেই বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবিসিকে দিয়েছেন দালান ভেঙে পড়ার হাস্যকর কারণ। এসব শোক প্রকাশ, বিতর্ক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য আসলে ঘটনার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে খুনিকে পালানোর পথ করে দেওয়ার উদ্যোগ। ফাটল ধরা দালানটির মালিককে বাঁচানোর তোড়জোড় চলছে। রাজউক মামলা করেছে ইমারত আইনের ১২ ধারায়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
হায়! এ পর্যন্ত জানা তিন শতাধিক শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের শাস্তি কি তবে এতটুকুই? অথচ আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে একজনকে খুন করলেই তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। পুলিশের মামলায় হত্যার অভিযোগ বলা হলেও সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়নি, বিশেষ করে জমি ও ভবন উভয়েরই মালিক কাগজপত্রে সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক। মামলায় তাঁকে আসামি না করলে মামলা চলাকালে বিজ্ঞ উকিল খুব সহজেই আদালতে প্রমাণ করে দিতে পারবেন, মামলায় গলদ আছে, সোহেল রানা ভবনের মালিক নন, ওই ভবনের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই ছিল না। হয়তো পুলিশকে ভর্ৎসনাও করা হবে ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে এত ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডির বিচার করা গেল না বলে, যেমন বলা হয়েছিল সিমির আত্মহত্যার রায়ে।
স্পেকট্রামের শাহরিয়ার, ফিনিক্সের দীন মোহাম্মদ, তাজরীন ফ্যাশনসের দেলোয়ার—কারও কিছু হয়নি। পার পেয়ে যাবেন রানা প্লাজায় যে চারটি গার্মেন্টস ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শ্রমিকদের কাজে ঢুকতে বাধ্য করেছেন, সেই সব মালিক—মাহবুবুর রহমান, বজলুস সামাদ আদনান, মো. আমিনুল ইসলাম ও মো. আনিসুর রহমান।
মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ১১১ হোক বা হোক ২৮১ কিংবা ৩০০ বা ৫০০, কেটে ফেলা হোক হাত কিংবা উড়ে যাক পা—বিজিএমইএ কিংবা মালিকপক্ষ বা রাষ্ট্র কিংবা আমরা কিছুই করিনি কোনো দিন। আসলে সংখ্যা বৈ মানুষ তো মনে করিনি এসব শ্রমিককে আজও। শুধু তাঁদের শ্রমের মুনাফায় স্ফীত আমাদের অর্থনীতি, আমাদের জীবন।
নূপুর পরা নিথর ‘পা’ আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর প্রতিবাদ। আমরা কি এই প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পারছি? রাষ্ট্র কি এবারও এই গণহত্যার বিচার করবে না? না করলে আমরা কী করব, ভেবেছি কি কিছু?
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment