অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতেও অব্যবস্থা আর অনিয়ম আছে। কিন্তু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাঁর এ বক্তব্য আমার কাছে অন্যায় বলেই মনে হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাঁকে ভর্ৎসনা করতে হবে, অভিযোগটা খতিয়ে দেখার কি প্রয়োজন নেই? আর যদি তা প্রমাণিত হয়, তবে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে, তা বাদ দিয়ে গালিগালাজ করাটা কি খুব শোভন? তা-ও রোগীদের সামনে? রোগীদের এই চিকিৎসকেরাই চিকিৎসা দেবেন। তাঁদের যদি রোগীদের সামনেই অপদস্থ করা হয়, তবে রোগীরা কি আর এঁদের কাছে চিকিৎসা নিতে ভরসা পাবেন, নাকি চিকিৎসকেরা তাঁদের চিকিৎসা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তিনি যেহেতু চিকিৎসকদের ‘অমানুষ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, সেহেতু বলা যায়, চিকিৎসকদের অধিকার তাঁর কমিশনের আওতায় পড়ে না। সেই নিরিখে ‘রক্তচোষা’ বললেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না!
শিশু ওয়ার্ডে পরিদর্শনে গেলে এক রোগী অভিযোগ করেন যে অসুস্থ শিশুপুত্রের চিকিৎসা পাচ্ছেন না, বাইরে থেকে খাবার ও ওষুধ কিনে ছেলেকে খাওয়াতে হচ্ছে, টয়লেট ও ওয়ার্ডের মেঝে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত, হাসপাতালের বিছানার বালিশ ও চাদর রোগীদের ঘর থেকে এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। অভিযোগগুলো হয়তো সত্য। কিন্তু একটা জিনিস সবার জানা উচিত, হাসপাতালের সেবা একটা টিমওয়ার্ক। তার মধ্যে শুধু চিকিৎসক নয়, আরও কিছু ব্যক্তি যেমন—নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, দারোয়ান, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ড মাস্টার, খাবার সাপ্লাইয়ের জন্য কন্ট্রাক্টর, অনেকেই থাকেন। সর্বোপরি, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের জন্য আলাদা প্রশাসন থাকে, চিকিৎসকেরা নন। তাহলে তিনি কেন ঢালাওভাবে চিকিৎসকদেরই গালিগালাজ করলেন?
এ ছাড়া তিনি আরও কিছু মন্তব্য করেছেন, যা অনভিপ্রেত। তিনি জানতে চেয়েছেন চিকিৎসকদের ‘আর কত বাড়ি-গাড়ির দরকার?’ বাড়ি-গাড়ির আকাঙ্ক্ষা থাকাটা কি অন্যায়, বেআইনি নাকি মানবাধিকারের লঙ্ঘন? যদি সৎ উপায়ে আয় করে বাড়ি করা হয়, তবে তার জন্য গালাগাল শুনতে হবে কেন? তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু চিকিৎসকেরাই একাধিক গাড়ি আর বাড়ির মালিক, অন্য কোনো পেশার লোকদের কারও বাড়িঘর নেই। নাকি ‘অমানুষ’ বিধায় গাড়ি-বাড়ি করা চিকিৎসকদের জন্য নিষিদ্ধ? আর দশটা পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ আয়ে যত খুশি দালান তুলতে পারবেন আর চিকিৎসকদের জীবন সেবার মহান ব্রত নিয়ে উৎসর্গ করতে হবে, এটাই বুঝি নিয়ম?
চিকিৎসকেরা কেন অফিস সময়ের পর অন্যত্র রোগী দেখেন, তা নিয়ে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তা বিস্ময়কর। সরকারি চিকিৎসকদের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিস অবৈধ নয়। অথচ তাঁর মত অনুযায়ী, এই বৈধ কাজটি যাঁরা করছেন, তাঁদের নাকি চাকরিতে থাকা উচিত নয়। ওই সময় যেসব রোগীকে তাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁরা কোথায় চিকিৎসা নেবেন? আমাদের দেশে মানুষ বেশি, রোগীর সংখ্যাও বেশি, সেই তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও অপ্রতুল। তাই চিকিৎসক শুধু নিজের প্রয়োজনেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তা নয়, রোগীদেরও তাঁদের প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। রোগীদের যে সেবা দেওয়া হচ্ছে, তার কি কোনো মূল্যই নেই? টাকাটাই কি মুখ্য? আমাদের দেশে চিকিৎসক তো আর হাজারে হাজারে নেই, রোগীরা কি মানবাধিকার কমিশনে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নেবেন?
অফিস সময়ের পরে কোনো চিকিৎসক মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের রোগের চিকিৎসার জন্য তাঁকে দেখলে তাঁরও কি সরকারি চাকরি ছাড়তে হবে? চিকিৎসক নামক যে ‘অমানুষ’ বা ‘রক্তচোষার’ প্রয়োজনীয়তা যে কারোরই যেকোনো সময় লাগতে পারে। তাঁকে গালিগালাজ দিয়ে কি ভালো সেবা পাওয়া সম্ভব?
রোগীর যেমন মানবাধিকার আছে, তেমনি আছে চিকিৎসকেরও। একজন চিকিৎসক অনেক কিছুকে বিসর্জন দিয়ে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। অফিস সময়ের পরে আর কোনো পেশাজীবী এত পরিশ্রম করেন? একজন চিকিৎসকের কোনো ছুটি নেই। রোগীর প্রয়োজনে চিকিৎসককে যেতেই হয়। পরিবার-পরিজনের সঙ্গেও তিনি সময় কাটাতে পারেন না। পুরো জীবনটাই রোগীর সেবায় নিয়োজিত। এমনকি নিজের রোগের চিকিৎসাটাও অনেক চিকিৎসকের করার সময় হয় না।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে দেশের চিকিৎসাসেবা আশানুরূপ নয়। এর জন্য শুধু চিকিৎসকেরা দায়ী নন। সমাজের সর্বব্যাপী যে নৈতিক অবক্ষয় বিরাজ করছে, চিকিৎসকদের মধ্যেও তাঁর সংক্রমণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ কর্মক্ষেত্রে থাকেন না, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন না, অসৎ পথে উপার্জনের চেষ্টা করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং তার একটা প্রক্রিয়াও থাকা উচিত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব চিকিৎসকই অমানুষ।
এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে একটি হাসপাতালের সব চিকিৎসকই অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। হাজার হাজার রোগীর জন্য গুটি কয়েক চিকিৎসক থাকবেন, কোনো যন্ত্রপাতি থাকবে না, ওষুধ থাকবে না, তাহলে তাঁরা কীভাবে চিকিৎসা করবেন? যে গুটি কয়েক সরকারি পেশাজীবী গ্রামপর্যায়ে সেবা দেন, তার মধ্যে চিকিৎসক অন্যতম, কিন্তু সেখানে তাঁদের কি সুবিধা দেওয়া হয়? পুরো কাঠামোটাকে ধ্বংস করে রেখে শুধু চিকিৎসককে ঘাড় ধরে সেবাদানে বাধ্য করা কেমন মানবিকতা?
দুঃখজনক হলো, যিনি এসব মন্তব্য করেছেন তিনি ব্যক্তিমাত্র নন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। এই পদের একটি সম্মান ও মর্যাদা আছে। তাঁর উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কাছ থেকে আমরা আরেকটু পরিমিত, রুচিশীল, দায়িত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক বক্তব্যই আশা করি। চিকিৎসকদের অপদস্থ করে মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে চিকিৎসাসেবার উন্নতি ঘটবে না, রোগীরাও উপকৃত হবেন না।
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ: ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment