বান্দরবানের থানচি থেকে বড় মদক পর্যন্ত পাথুরে স্রোতস্বিনী সাঙ্গু নদের রূপ অনেকেই উপভোগ করেছেন। নদীপথে বড় মদক থেকে মরংওয়াপাড়া আট কিলোমিটার। তার পরই শুরু হবে অন্য রকম সৌন্দর্যের জগৎ আন্ধারমানিক। দীর্ঘ এ নদীপথের দুই পাশের পাহাড়ের দেয়াল খাড়া নেমে গেছে পানির গভীর তল পর্যন্ত। তার খাঁজে খাঁজে বয়ে চলেছে অসংখ্য ঝরনা। পাহাড়ের উঁচু উঁচু গাছ ভেদ করে সূর্যের রশ্মি পৌঁছায় খুব কম। তাই এ জায়গার নাম আন্ধারমানিক। কিছু গাছ নুয়ে পড়েছে পানিতে। তারই ডালে বসে সাপ খুঁজছে তার শিকার। গভীর সবুজাভ পানিতে বৈঠার টানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর নির্জনতা ভঙ্গ করা পাখিদের কিচিরমিচির এক মোহময় আবহ সৃষ্টি করে। মোটকথা, আন্ধারমানিকের সৌন্দর্য বুঝতে সজাগ রাখতে হবে আপনার সব ইন্দ্রিয়কেই। এমনকি ক্যামেরাটাও ঠিকঠাক না চললে সারা জীবন আফসোস রয়ে যাবে।
এই পথে একটা সময় লিক্রি (উইথং/বুচিং পাড়া) এসে পৌঁছালে রাতযাপন এখানে করতে হবে। লিক্রি থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এগোলে পশ্চিম থেকে ব্রংক্ষিয়াং খাল এসে মিশেছে সাঙ্গুর সঙ্গে। এ খালের মুখেই প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
এক কিলোমিটার পরই পূর্ব পাশের মদক রেঞ্জ থেকে আসা ঝিরির নাম পানছড়া। এটি মোটামুটি প্রশস্ত, দুই পাড় সমতল, তলা অগভীর। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এ পানছড়া-সাঙ্গুর মিলনস্থল থেকেই সাঙ্গু নদ সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে দক্ষিণ থেকে যে ঝিরি প্রচণ্ড বেগে ছুটে এসেছে সেটি কী? জানা গেল, এ ঝিরি শঙ্খ ঝিরি বা সাপাছড়া নামেই পরিচিত।
লিক্রি থেকে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণের লাগপাইন পাড়ার বয়স বেশি দিন হয়নি। পশ্চিম দিক থেকে আসা ছোট তংক্ষিয়াং ও বড় তংক্ষিয়াং ঝিরিমুখের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিশাল সমতল এলাকাজুড়ে অস্থায়ী এ পাড়া। এটি সাপাছড়া ও লাগপাইন ঝিরির মিলনমোহনায় অবস্থিত। লাগপাইন ঝিরি ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা পাহাড় বরাবর অগ্রসর হতে থাকি আমরা। একটা সময় খুব দুর্গম আর সরু হতে থাকে এ ঝিরি। এলোপাতাড়িভাবে পড়ে থাকা বড় বড় পাথর আর বেত, লতা, গুল্মের জাল ভেদ করে হাঁটা মুশকিল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দিক থেকে অসংখ্য পাথুরে ছড়া আসলেও সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে শুকিয়ে গেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, সাঙ্গু নদের উৎস বাংলাদেশের দক্ষিণে মিয়ানমারের মইন টং থেকে। কিন্তু গিয়ে দেখি, সীমান্তের ওপারে খুব সংকীর্ণ স্থির এক ঝিরি। তা-ও আবার বাংলাদেশের সীমানায় তার ঢোকার মুখে বাধা। হয়তো ভূমিধসে এমন হয়েছে।
লাগপাইন ঝিরির পরই দক্ষিণ সীমান্ত পাহাড় থেকে অনেকখানি বাঁকা হয়ে মিলেছে থাকব্রো ঝিরি। শঙ্খছড়া এখান থেকেই বাঁক নিয়েছে পূর্ব দিকে। বন্য প্রাণীদের নির্বিচার চলাফেরা এখানে। তাদের পায়ের ছাপই আমাদের পথ দেখাতে সাহায্য করেছে। এদিকটায় বেশ মাছ পাওয়া যায়। কয়েকটা মাছধরে পাড়ে বসেই কিছুটা পুড়িয়ে খেয়ে নিলাম পেট পুরে। যতই এগোচ্ছি, পাথরগুলো প্রমাণ আকারের হচ্ছে। পানির প্রবাহও অনেক। একটা সময় আমরা দেখলাম, শঙ্খছড়া আবার উত্তরে বাঁক নিয়েছে। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব কোণের পাহাড় মদকটং যার উচ্চতা প্রায় তিন হাজার পাঁচ ফুট। মদকটং আঞ্চলিকভাবে মুরং সম্প্রদায়ের কাছে নাসাই হুম বা হাতিপাহাড় নামে পরিচিত। এ নাসাই হুমই হচ্ছে মদক রেঞ্জের দক্ষিণে সর্বশেষ পাহাড়চূড়া অথবা বলা যেতে পারে বান্দরবানের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব কোণের পাহাড়। নাসাই হুম থেকে যে ঝিরি এসেছে, তা নামবিহীন হলেও যথেষ্ট খরস্রোতা আর জোরালো। দৈত্যাকার সব বোল্ডার এখানে-ওখানে। কোনোটাকে এড়িয়ে, কোনোটাকে টপকিয়ে আবার কোনোটার সরু ফাঁক দিয়ে চলছিল আমাদের অগ্রসর হওয়ার যুদ্ধ। আশপাশ থেকে আরও কিছু ঝরনাধারা খাড়া ধাপে তুমুল বেগে নেমে এসে মিশেছে নামবিহীন নাসাই হুমের ঝিরির সঙ্গে। এ ঝিরি শঙ্খছড়ার অন্যতম সহযোগী বলে মনে হলো আমাদের কাছে।
সাঙ্গু নদের উৎপত্তিস্থল অনুসন্ধান করতে এসে দুর্গম বনভূমির অসংখ্য পশুপাখির দেখা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। কিছু দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপ লক্ষ করা যায়। উখিয়া থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে আসা এবং মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ঐতিহাসিক হাতির ট্রেইল ধরে হাঁটা আমাদের জন্য ছিল রোমাঞ্চকর। উল্লুক, ভালুক, সাপ আর নানা প্রজাতির পাখির ছড়াছড়ি। বিশেষ করে ধনেশ পাখির আখড়া বলা চলে এই অঞ্চলটিকে। লুকায়িত অসংখ্য ঝরনাধারা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি এতটাই দুর্গম যে প্রশাসনিক সহায়তা ছাড়া সাধারণ মানুষের বিচরণ জীবনের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
dwayexpeditors@gmail.com
0 comments:
Post a Comment