সরেজমিনে দেখা যায়, রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নের হিমছড়ি পর্যটনকেন্দ্রের পাশেই পেঁচারদ্বীপ। এখানে সাগর ও পাহাড়ের অপূর্ব মেলবন্ধন নজর কাড়ে। প্রকল্প এলাকার পশ্চিমে সমুদ্রসৈকত, পূর্বে পাহাড়, উত্তরে হিমছড়ি পর্যটনকেন্দ্র এবং দক্ষিণে ইনানী সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশ ঘেঁষে পূর্ব দিকে প্রকল্পের কাজ চলছে। সীমানাপ্রাচীর তৈরির কাজ শেষের পথে। স্থাপনা ও রাস্তা তৈরির কথা বলে পাহাড় কাটা চলছে।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিকবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি হবে দেশের প্রথম এবং একমাত্র সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর জন্য কক্সবাজার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। কিন্তু ইনস্টিটিউট তৈরির নকশায় পাহাড় না কেটে স্থাপনা করার কথা রয়েছে। এখন কেন পাহাড় কাটা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।’
কক্সবাজার গণর্পূত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বড় বড় স্থাপনাগুলো পাহাড় না কেটে (পাহাড়ের ওপর) করা হবে। তবে রাস্তা করার জন্য কিছু কিছু পাহাড়ের ওপরের অংশ কেটে সমান করা হচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘এখানে ওভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে না।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রকল্পের জন্য পাহাড় কাটার অনুমতি চেয়ে গণপূর্ত বিভাগ একটি আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ওই জায়গা পুরোটাই পাহাড়শ্রেণীর। তাই তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার পরও তারা পাহাড় কাটছে জানতে পেরে তাদের নোটিশ করা হয়েছে। এর পরও পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে মামলা করা হবে।
সর্বশেষ গত রোববার পেঁচারদ্বীপে গিয়ে দেখা যায়, এস্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। কাটা মাটি ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে সেখানে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, শ্রমিকেরা কোদাল-শাবল দিয়ে পাহাড় কাটছেন। শ্রমিকেরা জানান, প্রতিদিন ৮০-১০০ জন শ্রমিক পাহাড় কাটা ও রাস্তা তৈরির কাজ করেন। শ্রমিকেরা স্থানীয়।
সূত্রগুলো বলছে, শুরুতে শ্রমিক দিয়ে পাহাড় কাটা হলেও স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সরেজমিনে পরিদর্শন ও প্রশাসনের কাছে প্রতিকার চাওয়ার পর এখন এস্কেভেটর দিয়ে দ্রুত কাটা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ৪০ একর প্রকল্প এলাকার পুরোটাই পাহাড়ি ভূমি। সরকারি নথিপত্রেও জমির শ্রেণী পাহাড়ি বলে উল্লেখ আছে। বড় এবং লাগাতার বলে পাহাড়ের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, আনুমানিক ২৫-৩০টি পাহাড় রয়েছে এখানে। এগুলোর গড় উচ্চতা ৫০ থেকে ৮০ ফুট।
মেরিন ড্রাইভ সড়কের পূর্ব পাশে নির্মাণাধীন ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটক থেকে পূর্ব দিকে দুটি রাস্তা চলে গেছে। একেকটি রাস্তা আধা কিলোমিটার দীর্ঘ। এগুলো তৈরির জন্যই তিনটি পুরো এবং সাতটি পাহাড়ের অংশবিশেষ কাটা হয়েছে।
কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইনস্টিটিউটটি নির্মাণে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৮১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া শেষে তিন মাস আগে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা জানান, কক্সবাজারে পাহাড় কাটা বন্ধে গত জুনে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। আদালতের ওই আদেশে পাহাড় কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসন এখন নিজেরাই পাহাড় কাটছে। এবং তারা কোনো অনুমোদনের তোয়াক্কা করেনি।
গত ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কক্সবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের নেতারা পাহাড় কাটার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে অনতিবিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধের দাবি জানান। ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ইকরাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তিনটি পাহাড় কাটতে দেখেছি। পাহাড়ের ফলদসহ নানা বৃক্ষ কেটে ফেলতে দেখা গেছে। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাউকে পাওয়া যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত ছড়াসহ (পাহাড়ি খাল) নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে। এতে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ। আমরা মনে করি, পাহাড় ও গাছগাছালি না কেটেই স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আব্দুল কুদ্দুস (নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার)] prothom-alo
0 comments:
Post a Comment