শুনে মাও খুশি। বউও খুশি।
বাস্তবে এমন দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান একটু কষ্ট-কল্পনাই বটে। চিরায়ত বউ-শাশুড়ি দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে যে মানুষটার প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি, তিনি একই সঙ্গে মায়ের পুত্র এবং বউয়ের স্বামী। মায়ের সঙ্গে তাঁর নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক—অবিচ্ছেদ্য ও চিরন্তন। আর বউয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা নির্ভরতার—চিরকালীন ও আমৃত্যু। তাঁর কাছে দুটো সম্পর্কই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
দুই প্রজন্মের এই দুই নারীর বিরোধ যদি চরমে ওঠে, তাহলে তার মাঝখানে পড়ে ‘অসহায়’ মানুষটার অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। কপাল ভালো হলে, কখনো মেলে দারুণ সমাধান। কখনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে হাবুডুবু।
ছোটবেলা থেকেই যে ছেলে মায়ের আঁচল কিংবা মায়ের হাতের রান্না ছাড়া কিছু বুঝতই না, বিয়ের পরে সেই ছেলে হঠাৎ করেই ‘স্ত্রৈণ’। মায়ের এটা মেনে নেওয়া কঠিন। মানুষ তো সে, রোবট তো আর না।
মায়ের মনে থাকে, আহা, ছেলেটা বুঝি পর হয়ে যাচ্ছে। আর ছেলে যদি মায়ের কথা বেশি বলে বউ ফুঁসতে থাকে, দেখেছ, মা এখনো ছেলেকে কবজা করে রেখেছে। দিন যায়, ক্ষোভ বাড়ে, জন্ম নেয় ঝামেলা। কোনো ঘটনায় ছেলে যদি মায়ের পক্ষ নেয়, বউয়ের মুখজুড়ে অন্ধকার। আর বউয়ের পক্ষ নিলে মায়ের মনে কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। কই যাই!
নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘নকশা’-তে সুবন্ধু সমীপেষু বিভাগে পাঠকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা অনেক বেশি ঘরকেন্দ্রিক। ঘরের ক্ষমতা ধরে রাখতে, মা আর বউ দুজনেরই ভরসা ছেলে। ব্যাপারটা এমন, ছেলে যাঁর পক্ষে, জয় যেন তাঁরই। তবে আশার কথা হচ্ছে, আজকাল বউ-শাশুড়ি দুজনই বাইরে কাজ করেন। এ কারণে তাঁদের বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ঘরের বাইরে আজকাল এত বেশি চাপ সামলাতে হয় যে বাড়ি ফিরে শান্তিপূর্ণ বসবাসের স্বার্থে ছোটখাটো বিষয়গুলোতে আপনাআপনি সমঝোতা হয়ে যায়। আরও একটা-দুটো প্রজন্ম পরে হয়তো সমস্যাটা এত বেশি প্রকট থাকবে না।’
রায়হান ইসলাম বিয়ে করেছেন সাত বছর হলো। মা, বউসহ বেশ ভালোভাবেই তাঁর দিন কেটে যাচ্ছে। তাঁর মতে, ছেলে যদি বুদ্ধিমান হয়, তাহলে বিয়ের পরও সে মায়ের সঙ্গে আগের মতো সম্পর্ক চালিয়ে যাবে। এতে পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা তৈরি হবে না। ঘরে বউ আসার আগে মায়ের সঙ্গে পরামর্শও করে নেওয়া যেতে পারে, যাতে নতুন সদস্যের কোনো সমস্যা না হয়। এতে মায়ের মনে হবে, ছেলের নতুন জীবনেও তাঁর কিছু অবদান আছে। আবার বউও খুশি হবে তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে স্বামী যদি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রওশন জাহান বলেন, একসঙ্গে থাকতে গেলে খটোমটো লাগবেই। সব সময় তো আর মনমানসিকতা এক রকম থাকে না। ক্ষমা, ধৈর্য ও সহনশীলতার চর্চা বাড়লে ছোটখাটো বিষয় কখনোই বড় হয়ে উঠবে না। মাকে বুঝতে হবে, বিয়ের পরে ছেলের আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বউকেও বুঝতে হবে, ছেলের কাছে মায়ের কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। সেই দায়িত্বটা পালনে ছেলের সঙ্গে তাঁকেও সহযোগিতা করা উচিত। তাহলে সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে।
তবে মূল দায়িত্বটা অবশ্যই ছেলের। তাকে অবশ্যই প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কিংবা সে কোনো দিকে কান না দিয়ে নিজের মতোও থাকতে পারে। কোনো একদিকে না হেললেই হলো। ছেলেকে বুঝতে হবে, মা তো আছেই, বউয়ের প্রতিও সহানুভূতিশীল হতে হবে। যেহেতু তিনি অচেনা একটি পরিবারে এসেছেন নিজের পরিবার ছেড়ে।
মা যদি ছেলেকে নিজের পছন্দের কিছু বানিয়ে খাওয়াতে চান, তাহলে ছেলের উচিত বউকে অন্য কিছু তৈরি করতে উৎসাহিত করা। মা ও বউয়ের মধ্যে কে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্বচ্ছন্দ, সেটা শুরুতেই ঠিক করে নেওয়া দরকার। এতে দুজনই নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে সচেতন হবেন। কিছু কিছু কাজ একদমই করা ঠিক নয়। তা হলো, একজন সম্পর্কে অন্যকে মন্দ কথা বা নালিশ, রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ প্রকাশ না করা। অধিকারবোধ নিয়েই যেহেতু সব গোলমাল, তাই দুটো সম্পর্ককেই সম্মান করলে, সচেতন থাকলে টানাপোড়েন কম হবে। কারণ, একজনের অধিকারবোধের প্রকাশ আরেকজনের মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তোলে।prothom-alo
0 comments:
Post a Comment