ফারুক ওয়াসিফ
নিছক কিছু দুর্বৃত্ত পুলিশের শাস্তির দাবি এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এই লেখার উদ্দেশ্য এক মা ও মেয়ের জীবন বাঁচানো। এই লেখার উদ্দেশ্য আমাদের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও বাঁচানো। টানা ছয়টি দিন-রাত একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে মা ও মেয়েকে নির্যাতন চালানোর পর মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। না করুন, সেই চেষ্টা যদি তিনি আবার করেন, তার দায় কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর বর্তাবে না? এ জন্যই আমরা চাই, অন্তত নিজের দায় বাঁচাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু করুন। লিমন-কাহিনির মতো অন্যায়ের আরেকটি দীর্ঘ কাহিনি না জন্মাক।
মা ও মেয়ের সংসার। বাবা পুরুষটি কয়েক বছর আগে খুন হয়েছেন। কিন্তু সেটাই মা-মেয়ের দুর্ভাগ্যের শেষ ছিল না, সেটাই ছিল শুরু। স্বামী খুন হওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে মা কুষ্টিয়া ছেড়ে রাজবাড়ীতে বসত গাড়েন। মেয়ে শুরু করে কলেজে যাওয়া। তারপর একদিন, ৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পুলিশ আসে। কুষ্টিয়ার জেলা পুলিশকে কেন এত দূর উজিয়ে রাজবাড়ী এসে ‘অপরাধী’ ধরতে হলো? তাও নিছক সন্দেহের বশে! যেখানে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করার কথা, সেখানে দুই দিন দুই রাত আটক রাখার কী কারণ? প্রথমে তাঁদের নেওয়া হয় শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের খোকসা থানায়। সেখানে তাঁদের ওপর নির্যাতন চলে। এরপর নেওয়া হয় কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ লাইনে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ে। আমরা জানলাম, এসব কার্যালয়ে অন্ধকার নির্যাতনকক্ষ থাকে। সে রকম এক কক্ষে আরও চার দিন আটকে রেখে নির্যাতন চলে। খবরটি জানাজানি হলে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন দিলে আবার গ্রেপ্তার করা হয় খুনের মামলায়। আবার তোলা হয় আদালতে। সেই আদালত এমনই আদালত, নিপীড়িতদের ফরিয়াদ না শুনে তাঁরা পুলিশের চাওয়ামতো মা ও মেয়েকে জেলে পাঠান। কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ, খোকসা থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশের পর এবার তাঁদের ‘ব্যবস্থা’ করে ১২ কিলোমিটার দূরের কুমারখালী থানার পুলিশ। এভাবে বিভিন্ন থানার বিভিন্ন ধরনের পুলিশের হাত থেকে হাতে বদল হতে হতে কী দশা হয়েছিল তাঁদের? মানুষের ওপর, সরকারের ওপর, আইনের ওপর, মানবাধিকারের ধারণার ওপর কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা? নরকের পথও কি এত দীর্ঘ হয় নাকি? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা কি এ রকম বেওয়ারিশ নাকি? তাদের নিয়ে যা খুশি তা করা চলে নাকি?
র্যা বের গুলিতে পা হারানো লিমন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আর ক্রমাগত নিপীড়িত হতে থাকা এই মা ও মেয়ে এখন মানবাধিকার বিলয়ের প্রতীক। এই প্রতীক যারা সৃষ্টি করেছে, সেই দুর্বৃত্ত নির্যাতক পুলিশ সদস্যদের নিয়ে আমরা কী করব?
একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ব্যক্তিদের বয়ান আমরা শুনেছি। একটা পর্যায়ে তাঁরা ভাবতেন, এর কি কোনো শেষ নেই? অনেকে শেষ দেখে যাওয়ার আগেই মারা গিয়েছেন, অনেকে আত্মহত্যা করেছেন, অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছেন। এই মেয়ে ও মা ছয় দিন কুষ্টিয়ার খোকসা থানার অন্ধকার হাজতে নির্যাতিত হতে হতে হয়তো ভাবছিলেন, এর কি শেষ নেই? না, নেই। ৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার সময় যে দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়েছিল, তা এখনো চলছে। কুষ্টিয়া জেলে বসে হয়তো তাঁরা তালাশ করছেন, কোথায় এর শেষ? কোথায় এর শেষ মাননীয় পুলিশপ্রধান, কোথায় এর শেষ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? দিনাজপুরের ইয়াসমিন, চট্টগ্রামের সীমা চৌধুরীদের মতো ঘটনার কি কোনো কমতি পড়বে না বাংলাদেশে? খবরটি পড়ে প্রথম আলোর অনলাইনে এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘এ আমরা কোথায় আছি?’ সত্যিই, এ আমরা কোথায় বাস করছি? কোন দেশ, কোন সময়, কোন পরিবেশে?
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এ রকম অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে প্রতিদিন। কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর দেওয়ার মালিক যাঁরা, আসলেই বলবার মতো কোনো উত্তর তাঁদের আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা যেমন চলছেন, তেমনই চলতে থাকবেন বলে হয়তো বিশ্বাস করেন। সত্যিকার উত্তরের বদলে তাঁদের আছে মিথ্যা আশ্বাস, মেকি তৎপরতা আর উদাসীনতার হাসি। সেই হাসি নিরাপত্তাহীনতার ভয় আরও বাড়ায়। গত মাসেই মিরপুরে এ রকমই এক মা ও তাঁর শিশুকন্যা পুলিশের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন বলে অভিযোগ প্রকাশিত হয়। এঁরাও ছিলেন খুনের শিকার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও শিশুকন্যা। আসল খুনিদের আড়াল করতে সেই নারীকেই উল্টো স্বামী হত্যার দায়ে ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকার ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। চোখের সামনে মায়ের নির্মম অপমানের ধাক্কা ছোট্ট মেয়েটির মানসিক সুস্থতা নষ্ট করে ফেলে।
গত জুন মাসে ঢাকার জেলা জজ আদালত চত্বর থেকে বাবা, মা ও মেয়েকে প্রহার করতে করতে পুলিশ ক্লাবে নিয়ে তিনজনকে তিন ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন কর হয়। মা এক কানে স্বামীর চিৎকার শুনেছেন, অন্য কানে শুনেছেন মেয়ের আর্তনাদ। কিন্তু পুলিশ কিছুই শুনছে না, থামছে না, মানছে না। এই পুলিশ বাহিনীই তো মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়েছিল! যাকে সেদিন তারা প্রতিরোধ করেছিল, আজ তাদের আচরণ তাদের মতোই মানবতাবিরোধী হয়ে উঠছে। আমরা দেখেছি, পুলিশ বাহিনীর সদস্য অর্থের বিনিময়ে খুন করেন। চুরি-ডাকাতি-ঘুষের বিস্তারের থেকেও এটা ভয়াবহ। পুলিশের কাজ আর অপরাধীদের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না। পুলিশ বাহিনী কি ঠিক করেছে, নির্যাতিত পরিবারের সংখ্যা তারা বাড়িয়েই যাবে? এতগুলো ঘটনায় এত এত থানার এত এত পুলিশ জড়িত যে এসব আর বিচ্ছিন্ন ব্যাপার বলে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। দেশে বাড়তে থাকা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব, যখন পুলিশ নিজেই নারীর জন্য বিরাট হুমকি হয়ে উঠছে? একের পর এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসেন, পুলিশের নতুন নতুন প্রধান আসেন। তাঁদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, পুলিশ এখন কতটা আধুনিক, কতটা মানবিক। পুলিশ বাহিনীতে মানবাধিকারের প্রশিক্ষণের খবরও আমাদের জানানো হয়। আধুনিক, মানবিক, দক্ষ পুলিশই যদি সত্য হবে, তা হলে এমন লোম শিহরে ওঠা ঘটনা ঘটাচ্ছে কারা? পুলিশের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে সম্পর্কটা কী?
পরিচিত একটি শিশু বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়। তাকে প্রশ্ন করা হলো, বাবা, কেন তুমি পুলিশ হতে চাও? চেহারায় ডাঁট এনে সে বলে, ‘তা হলে যে সবাই আমাকে ভয় পাবে!’ পুলিশের এতে খুশিই হওয়ার কথা। মানুষের ভালোবাসা দূরে থাক, আস্থা ও বিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন তাদের আছে বলে মনে হয় না। অপরাধের হিড়িক দেখে তো বলার উপায় নেই, অপরাধীরা পুলিশকে খুব একটা ভয় পায়। পুলিশকে ভয় পায় নিরীহ সাধারণ মানুষ, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বা বিত্ত কম। নিদারুণ ভয় দিয়েই তারা পুলিশের মর্যাদা রক্ষা করে চলে। পুলিশও মনে হয় চায়, মানুষ তাদের ভয়ে কাঁপুক। এখনো দুরন্ত বাচ্চারা ঘুমাতে না চাইলে অনেক মা-ই কপট ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘ঘুমা, নইলে কিন্তু পুলিশ আসবে।’ অস্বীকার করা যাবে না, পুলিশ সম্পর্কে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই প্রথম অনুভূতিটি ভয়ের। ব্রিটিশ শাসকেরা পুলিশকে তৈরি করেছিলেন যতটা আইন প্রয়োগের জন্য, তার থেকে বেশি স্থানীয় জনগণকে ভয় দেখিয়ে চুপ রাখার জন্য। আমল বদলেছে, ভয়ের সংস্কৃতি লোপ তো পায়ইনি বরং বেড়েছে। পুলিশ এখন ভয়ের আরেক নাম। পুলিশের ভয়ে যখন সাধারণ মানুষ কাঁপে, তখন মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র—সবই মূলসুদ্ধ কাঁপতে থাকে। মানুষ ভয়ে কাঁপবে আর সরকার থাকবে নিষ্ক্রিয়তায় অটল; এটা হতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faৎukwasif@yahoo.com
মা ও মেয়ের সংসার। বাবা পুরুষটি কয়েক বছর আগে খুন হয়েছেন। কিন্তু সেটাই মা-মেয়ের দুর্ভাগ্যের শেষ ছিল না, সেটাই ছিল শুরু। স্বামী খুন হওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে মা কুষ্টিয়া ছেড়ে রাজবাড়ীতে বসত গাড়েন। মেয়ে শুরু করে কলেজে যাওয়া। তারপর একদিন, ৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পুলিশ আসে। কুষ্টিয়ার জেলা পুলিশকে কেন এত দূর উজিয়ে রাজবাড়ী এসে ‘অপরাধী’ ধরতে হলো? তাও নিছক সন্দেহের বশে! যেখানে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করার কথা, সেখানে দুই দিন দুই রাত আটক রাখার কী কারণ? প্রথমে তাঁদের নেওয়া হয় শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের খোকসা থানায়। সেখানে তাঁদের ওপর নির্যাতন চলে। এরপর নেওয়া হয় কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ লাইনে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ে। আমরা জানলাম, এসব কার্যালয়ে অন্ধকার নির্যাতনকক্ষ থাকে। সে রকম এক কক্ষে আরও চার দিন আটকে রেখে নির্যাতন চলে। খবরটি জানাজানি হলে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন দিলে আবার গ্রেপ্তার করা হয় খুনের মামলায়। আবার তোলা হয় আদালতে। সেই আদালত এমনই আদালত, নিপীড়িতদের ফরিয়াদ না শুনে তাঁরা পুলিশের চাওয়ামতো মা ও মেয়েকে জেলে পাঠান। কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ, খোকসা থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশের পর এবার তাঁদের ‘ব্যবস্থা’ করে ১২ কিলোমিটার দূরের কুমারখালী থানার পুলিশ। এভাবে বিভিন্ন থানার বিভিন্ন ধরনের পুলিশের হাত থেকে হাতে বদল হতে হতে কী দশা হয়েছিল তাঁদের? মানুষের ওপর, সরকারের ওপর, আইনের ওপর, মানবাধিকারের ধারণার ওপর কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা? নরকের পথও কি এত দীর্ঘ হয় নাকি? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা কি এ রকম বেওয়ারিশ নাকি? তাদের নিয়ে যা খুশি তা করা চলে নাকি?
র্যা বের গুলিতে পা হারানো লিমন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আর ক্রমাগত নিপীড়িত হতে থাকা এই মা ও মেয়ে এখন মানবাধিকার বিলয়ের প্রতীক। এই প্রতীক যারা সৃষ্টি করেছে, সেই দুর্বৃত্ত নির্যাতক পুলিশ সদস্যদের নিয়ে আমরা কী করব?
একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ব্যক্তিদের বয়ান আমরা শুনেছি। একটা পর্যায়ে তাঁরা ভাবতেন, এর কি কোনো শেষ নেই? অনেকে শেষ দেখে যাওয়ার আগেই মারা গিয়েছেন, অনেকে আত্মহত্যা করেছেন, অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছেন। এই মেয়ে ও মা ছয় দিন কুষ্টিয়ার খোকসা থানার অন্ধকার হাজতে নির্যাতিত হতে হতে হয়তো ভাবছিলেন, এর কি শেষ নেই? না, নেই। ৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার সময় যে দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়েছিল, তা এখনো চলছে। কুষ্টিয়া জেলে বসে হয়তো তাঁরা তালাশ করছেন, কোথায় এর শেষ? কোথায় এর শেষ মাননীয় পুলিশপ্রধান, কোথায় এর শেষ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? দিনাজপুরের ইয়াসমিন, চট্টগ্রামের সীমা চৌধুরীদের মতো ঘটনার কি কোনো কমতি পড়বে না বাংলাদেশে? খবরটি পড়ে প্রথম আলোর অনলাইনে এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘এ আমরা কোথায় আছি?’ সত্যিই, এ আমরা কোথায় বাস করছি? কোন দেশ, কোন সময়, কোন পরিবেশে?
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এ রকম অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে প্রতিদিন। কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর দেওয়ার মালিক যাঁরা, আসলেই বলবার মতো কোনো উত্তর তাঁদের আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা যেমন চলছেন, তেমনই চলতে থাকবেন বলে হয়তো বিশ্বাস করেন। সত্যিকার উত্তরের বদলে তাঁদের আছে মিথ্যা আশ্বাস, মেকি তৎপরতা আর উদাসীনতার হাসি। সেই হাসি নিরাপত্তাহীনতার ভয় আরও বাড়ায়। গত মাসেই মিরপুরে এ রকমই এক মা ও তাঁর শিশুকন্যা পুলিশের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন বলে অভিযোগ প্রকাশিত হয়। এঁরাও ছিলেন খুনের শিকার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও শিশুকন্যা। আসল খুনিদের আড়াল করতে সেই নারীকেই উল্টো স্বামী হত্যার দায়ে ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকার ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। চোখের সামনে মায়ের নির্মম অপমানের ধাক্কা ছোট্ট মেয়েটির মানসিক সুস্থতা নষ্ট করে ফেলে।
গত জুন মাসে ঢাকার জেলা জজ আদালত চত্বর থেকে বাবা, মা ও মেয়েকে প্রহার করতে করতে পুলিশ ক্লাবে নিয়ে তিনজনকে তিন ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন কর হয়। মা এক কানে স্বামীর চিৎকার শুনেছেন, অন্য কানে শুনেছেন মেয়ের আর্তনাদ। কিন্তু পুলিশ কিছুই শুনছে না, থামছে না, মানছে না। এই পুলিশ বাহিনীই তো মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়েছিল! যাকে সেদিন তারা প্রতিরোধ করেছিল, আজ তাদের আচরণ তাদের মতোই মানবতাবিরোধী হয়ে উঠছে। আমরা দেখেছি, পুলিশ বাহিনীর সদস্য অর্থের বিনিময়ে খুন করেন। চুরি-ডাকাতি-ঘুষের বিস্তারের থেকেও এটা ভয়াবহ। পুলিশের কাজ আর অপরাধীদের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না। পুলিশ বাহিনী কি ঠিক করেছে, নির্যাতিত পরিবারের সংখ্যা তারা বাড়িয়েই যাবে? এতগুলো ঘটনায় এত এত থানার এত এত পুলিশ জড়িত যে এসব আর বিচ্ছিন্ন ব্যাপার বলে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। দেশে বাড়তে থাকা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব, যখন পুলিশ নিজেই নারীর জন্য বিরাট হুমকি হয়ে উঠছে? একের পর এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসেন, পুলিশের নতুন নতুন প্রধান আসেন। তাঁদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, পুলিশ এখন কতটা আধুনিক, কতটা মানবিক। পুলিশ বাহিনীতে মানবাধিকারের প্রশিক্ষণের খবরও আমাদের জানানো হয়। আধুনিক, মানবিক, দক্ষ পুলিশই যদি সত্য হবে, তা হলে এমন লোম শিহরে ওঠা ঘটনা ঘটাচ্ছে কারা? পুলিশের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে সম্পর্কটা কী?
পরিচিত একটি শিশু বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়। তাকে প্রশ্ন করা হলো, বাবা, কেন তুমি পুলিশ হতে চাও? চেহারায় ডাঁট এনে সে বলে, ‘তা হলে যে সবাই আমাকে ভয় পাবে!’ পুলিশের এতে খুশিই হওয়ার কথা। মানুষের ভালোবাসা দূরে থাক, আস্থা ও বিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন তাদের আছে বলে মনে হয় না। অপরাধের হিড়িক দেখে তো বলার উপায় নেই, অপরাধীরা পুলিশকে খুব একটা ভয় পায়। পুলিশকে ভয় পায় নিরীহ সাধারণ মানুষ, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বা বিত্ত কম। নিদারুণ ভয় দিয়েই তারা পুলিশের মর্যাদা রক্ষা করে চলে। পুলিশও মনে হয় চায়, মানুষ তাদের ভয়ে কাঁপুক। এখনো দুরন্ত বাচ্চারা ঘুমাতে না চাইলে অনেক মা-ই কপট ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘ঘুমা, নইলে কিন্তু পুলিশ আসবে।’ অস্বীকার করা যাবে না, পুলিশ সম্পর্কে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই প্রথম অনুভূতিটি ভয়ের। ব্রিটিশ শাসকেরা পুলিশকে তৈরি করেছিলেন যতটা আইন প্রয়োগের জন্য, তার থেকে বেশি স্থানীয় জনগণকে ভয় দেখিয়ে চুপ রাখার জন্য। আমল বদলেছে, ভয়ের সংস্কৃতি লোপ তো পায়ইনি বরং বেড়েছে। পুলিশ এখন ভয়ের আরেক নাম। পুলিশের ভয়ে যখন সাধারণ মানুষ কাঁপে, তখন মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র—সবই মূলসুদ্ধ কাঁপতে থাকে। মানুষ ভয়ে কাঁপবে আর সরকার থাকবে নিষ্ক্রিয়তায় অটল; এটা হতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faৎukwasif@yahoo.com
প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment