এ সম্পর্কে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাসপারস্কি জানিয়েছেন, ভাইরাস মাত্রই সমস্যার কারণ—তা সে শরীরের জন্যই হোক আর কম্পিউটারের জন্যই হোক। কিন্তু গত কয়েক বছরে কম্পিউটার ভাইরাসের প্রকোপ এতটাই বেড়ে গেছে যে তা বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে, সে তথ্য নিয়ে সন্তুষ্ট নয় অপরাধীরা। ২০১০ সালে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টে স্টাক্সনেট নামের ভাইরাস হামলার পর সাইবার অপরাধীরা তাদের আক্রমণের বিশালতা নিয়ে সবার চোখ খুলে দিয়েছে। ক্যাসপারস্কি জানান, তিনি সাইবার দুনিয়ার ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর এই উদ্বিগ্নতার কারণ হিসেবে পাঁচটি নির্দিষ্ট হুমকির কথা বলেছেন তিনি। তাঁর মতে, বিশ্বের তাবত্ কম্পিউটার ব্যবহারকারীর মাথার ওপর খড়গ হয়ে ঝুলছে এ হুমকিগুলো।
গাঢ় অন্ধকার: সাইবার যুদ্ধ
ক্যাসপারস্কির মতে, প্রথম হুমকি হচ্ছে, যুদ্ধ; পুরো অন্ধকার আদিম পরিবেশ। যুদ্ধ অর্থাত্ সাইবার যুদ্ধ। ঠিক যেমনটি ঘটেছে ২০১০ সালের স্টাক্সনেট ভাইরাস হামলার ফলে। চলতি বছরেও ইরান আবারও এমন হামলার শিকার হয়েছে। এ মাসেই কম্পিউটার ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে ইরান তাদের প্রধান তেল ক্ষেত্রগুলোর কম্পিউটার সিস্টেম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ক্যাসপারস্কি সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের হামলা ভবিষ্যতে আরও বেড়ে হবে। তখন হয়তো সাইবার অপরাধীরা বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রে হামলা করে পুরো দেশটাকেই অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে। কারোরই কিছুই করার থাকবে না। কারণ, বিশ্বের সব বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র প্রায় একই রকম পদ্ধতিতে তৈরি। সবগুলোই আক্রমণের লক্ষ্যের মধ্যেই রয়েছে। এ ধরনের আক্রমণ ঘটলে পৃথিবী ২০০ বছর পিছিয়ে বিদ্যুিবহীন সময়ে ফিরে যাবে। এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক হতে পারে। সাইবার অস্ত্র প্রয়োগ রোধে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির মতো সাইবার অস্ত্র প্রয়োগের বিরুদ্ধে চুক্তি করতে পারে। এ বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন পানেট্টাও সাইবার অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। তাই প্রতিরক্ষা হিসেবে নিজস্ব অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। সাইবার অস্ত্র তৈরিতে সংশ্লিষ্টরা প্রচুর অর্থ খরচ করছে বলেও জানিয়েছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা।
মানুষের নৈতিকতা: সামাজিক যোগাযোগের অপব্যবহার
সাইবার দুনিয়ার দ্বিতীয় হুমকি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের অপব্যবহার। ক্যাসপারস্কি জানিয়েছেন, সাধারণ ব্যবহারকারীর তথ্য অসত্ উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হওয়ার বিষয়টি ও তাদের অসত্ কাজে লাগানোর বিষয়টি সাইবার দুনিয়ার আরেকটি হুমকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান থেকে প্রচারপত্র ফেলে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারণা চালান হতো, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে এখন ঠিক তেমনটাই করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যেকোনো ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে ভীতি তৈরি করা হচ্ছে। অপরাধীরা তথ্য সব ধরনের মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য এ সুযোগ নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো বর্তমান বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ‘আরব বসন্ত’ তৈরির পেছনে সামাজিক যোগাযোগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্যাসপারস্কি জানিয়েছেন, দেশের বাইরে বসে দেশের বিরুদ্ধ কোনো শক্তি সাধারণ মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে এবং প্রচারণা চালিয়ে দেশের ক্ষতি করতে পারে।
শিশু: সাইবার রাজনীতি
বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে শিশুর বেড়ে ওঠার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেট প্রজন্মের শিশু ও মা-বাবার মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। আর এটাই এখন সাইবার জগতের তৃতীয় হুমকি। ইন্টারনেটের এই প্রজন্ম কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে মানিয়ে নেবে বা কি শিক্ষা নেবে—সেটা এখন সাইবার জগত্ নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাত্, ইন্টারনেটে শিশু তার রাজনৈতিক ধারণা পেয়ে যায়। কিন্তু একসময় যখন তারা ভোটাধিকার পাবে তখন যদি অনলাইন ভোটিং সিস্টেম না পায়, তবে তারা ভোট দিতে চাইবে না। তারা পুরো রাজনীতিকে পরিহার করবে। এতে পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভেঙে পড়তে পারে। মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।
কম্পিউটার হ্যাক: নতুন প্ল্যাটফর্ম
কম্পিউটার ব্যবহারকারীর জন্য ভাইরাস আক্রমণ নতুন কিছু নয়। তবে তাদের অজান্তেই তথ্য চুরি করে নিচ্ছে অপরাধীরা। প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন কম্পিউটার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে উন্নত হয়েছে অন্য ক্ষেত্রগুলোও। সবচেয়ে এগিয়েছে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট। হ্যাকাররাও তাদের আক্রমণের ধরন পাল্টে ফেলেছে। এখন তাদের লক্ষ্য স্মার্টফোন। স্মার্টফোনে তো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকার কথা নয়। তার পরও সাম্প্রতিককালের স্মার্টফোনগুলো এমন তথ্যের ভান্ডার, যা সাইবার অপরাধের জন্য ঈর্ষণীয়। এশিয়া, রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্য অনেক অংশেই প্রি-পেইড মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। এসএমএস ভাইরাসের সাহায্যে মোবাইল থেকে অর্থ সরিয়ে নেয় অপরাধী। কোনো কম্পিউটারই ভাইরাস প্রতিরোধী নয়। বিশেষ করে অ্যাপলের ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমকে ভাইরাস দুর্ভেদ্য মনে করা হলেও সম্প্রতি ম্যাকেও ভাইরাস বিপর্যয় নেমে এসেছে। সব ধরনের প্ল্যাটফর্মেই ভাইরাস ঠেকাতে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন ক্যাসপারস্কি।
উন্মুক্ত দুনিয়া: ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নিশ্চয়তা নেই
ইউজিন ক্যাসপারস্কির মতে, সাইবার জগতের পঞ্চম হুমকি হচ্ছে প্রাইভেসি। তিনি বলেন, সাইবার জগতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছু থাকছে না। গুগল স্ট্রিট ভিউ, চোখ ফাঁকি দিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী উড়ুক্কু ড্রোন, সিসিটিভি ক্যামেরার সাহায্যে অলক্ষ্যেই সাইবার জগতে চলে যাচ্ছে ভিডিও, ছবি ও নানা তথ্য। সাইবার জগতে প্রাইভেসি রাখার কোনো উপায় নেই। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইট অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে রাখছে এবং অর্থ লোলুপ এসব ওয়েবসাইট নিজের প্রয়োজনে অনুমতি ছাড়াই সেগুলো ব্যবহার করছে বা বিক্রি করছে। ওয়েবসাইট কতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে সে বিষয়ে একটা নীতিমালা থাকার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ক্যাসপারস্কি সতর্ক করে বলেন, প্রাইভেসি সমস্যা নিয়ে দিনের শেষে দেখা যাবে এটা একার সমস্যার চেয়ে পুরো দেশেরই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, দেশের মানুষের তথ্য দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে সাইবার অপরাধীরা। আর এমনটা হলে তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment