ময়মনসিংহের রিকশাচালক মো. জয়নাল আবেদিন ও তাঁর মমতাজ হাসপাতালের জন্য এ ভালোবাসা জানালেন সদ্য ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি পাওয়া মো. মামুন মোল্লা।
গত শনিবার প্রথম আলোর শেষের পাতায় ‘রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল’ শিরোনামে শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজে একজন রিকশাচালকের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা এবং মানুষের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এ গল্প পড়ে প্রথম আলোর পাঠকেরা অভিভূত, আবেগাপ্লুত হয়েছেন।
গত শনিবার প্রতিবেদনটি পড়ে তিন শতাধিক পাঠক প্রথম আলোর অনলাইনে জয়নাল আবেদিনের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সালাম, সহমর্মিতা জানিয়েছেন আবেগময় ভাষায়। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন জয়নালের হাসপাতালের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রথম আলোর সহায়তা চেয়েছেন তাঁরা।
এ ছাড়া গত দুই দিনে আরও প্রায় ১০০ জন প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি এবং সরাসরি জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের অনেকেই হাসপাতাল ও বিদ্যালয়টির জন্য আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে প্রথম আলোকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন।
দেশ ও প্রবাসের এসব সুহূদ পাঠকের অনুরোধ ও পরামর্শে এবং জয়নাল আবেদিনের আগ্রহে প্রথম আলো ট্রাস্ট গতকাল মমতাজ হাসপাতালের জন্য একটি ব্যাংক হিসাব খুলেছে। প্রথম আলো ট্রাস্ট/মমতাজ হাসপাতাল, হিসাব নম্বর: ২০৭১০০৭৯৫৯, ঢাকা ব্যাংক, কারওয়ান বাজার শাখা, ঢাকা।
প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থ দিয়ে সহায়তাকারীদের ইচ্ছা অনুযায়ী জয়নালের মমতাজ হাসপাতাল ও বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় এবং পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পত্রিকার মাধ্যমে এই ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ অনুদান প্রদানকারী ও পাঠকদের জানানো হবে। এই তহবিলের অর্থ ব্যয়ের হিসাবও পত্রিকার মাধ্যমে সবাইকে জানানো হবে।
গত শনিবার প্রথম আলোর অনলাইনে ‘রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল’ প্রতিবেদনটি বহুল পঠিত ও সর্বাধিক আলোচিত সংবাদের তালিকায় শীর্ষে ছিল। প্রতিবেদনটি পড়ে ৩১০ জন পাঠক তাঁদের মন্তব্য লিখেছেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনের বিষয়ে এটি অনলাইনে দেওয়া এ যাবতকালের সর্বোচ্চসংখ্যক প্রতিক্রিয়া।
পাঠক স্বর্ণা লিখেছেন, ‘হে বিজয়ী বীর, তোমাকে হাজার-কোটি সালাম।’ আরেক পাঠক লিখেছেন, ‘বিস্ময়াভিভূত হওয়ার মতো কাহিনি। তাঁকে অভিবাদন।’
জয়নালের জীবনগাথা পড়ে অনেকের চোখে পানি এসেছে। সে কথা তাঁরা নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন। জহিরুল আলম লিখেছেন, ‘এই কাহিনি পড়ে আমার চোখে পানি চলে আসে।’ ইয়াসিন হোসাইনের কথায়, ‘জয়নালের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। পিঁপড়ার মতো...।’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানহাসাদিয়া গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন জয়নাল আবেদিন ঢাকায় রিকশা চালান। তরুণ বয়সে বাবার করুণ মৃত্যুর পর জয়নাল একটি হাসপাতাল গড়ার প্রতিজ্ঞা করেন। বছরের পর বছর রিকশা চালিয়ে তিলে তিলে জমানো টাকায় বছর দশেক আগে গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল গড়েন তিনি। সঙ্গে একটি বিদ্যালয়ও। জয়নালের গড়া ছয় শয্যার ছোট্ট সেই হাসপাতালে দরিদ্র রোগীরা বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে, ওষুধ পাচ্ছে। রিকশা চালিয়ে উপার্জিত টাকায় ওষুধ কেনেন, চিকিৎসকের মাসোহারা দেন জয়নাল।
জয়নাল আবেদিন চট্টগ্রামের এক শিক্ষার্থীর ফোনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি গত দুই দিনে অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। অনেকে অনেকভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কিন্তু ছেলেটা যখন বলল, ‘চাচা, আপনি কি আর রিকশা চালাবেন? আপনার ছবি দেখে আমার বুকটা ফেটে গেছে। আমি লেখাপড়ার খরচের টাকা বাঁচিয়ে আপনাকে সাহায্য করব।’
কানাডাপ্রবাসী প্রকৌশলী রাশাদ হক ফোনে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিক দারাদের প্রতারণার ঘটনায় প্রচণ্ডভাবে লজ্জিত হয়েছিলাম। আজ রিকশাচালক জয়নালের খবর পড়ে গর্বে বুক ভরে গেছে।’ তিনি ‘জয়নাল আবেদিন: এ ম্যান উইথ এ ড্রিম’ নামে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে সবার কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। রাশাদ হক বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি আর্থিক সাহায্য পাঠাব। তবে চাই হাসপাতালটির জন্য প্রথম আলো একটি সাংগঠনিক কাঠামো করে সবাইকে সহযোগিতা করার পথ সুগম করে দেবে।’
আরও অনেকে ফোনে প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয়ে এবং এই প্রতিবেদকের কাছে একই অনুরোধ করেছেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যক্তি একই রকম অনুরোধ করেন। ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এক মাসের বেতনের একটি অংশ হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণে দিতে চান। বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, তাঁরা ব্যাংকের পক্ষ থেকে জয়নালের পাশে দাঁড়াতে চান।
অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী একজন সে দেশে বসবাসরত বাঙালিদের নিয়ে মহৎ এ মানুষটির পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, দুবাই ও সৌদি আরব-প্রবাসী অনেকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা আগ্রহ জানিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের মহিলাবিষয়ক একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁর স্বামী চিকিৎসক। তাঁকে দেওয়া বিভিন্ন কোম্পানির নমুনা-ওষুধ তিনি এখন থেকে জয়নালের হাসপাতালের জন্য পাঠাবেন।
চিকিৎসকদের একটি সংগঠন বলেছে, তারা শিগগির জয়নালের বাড়ি যাবে এবং সেখানে সপ্তাহে একজন চিকিৎসক পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।
0 comments:
Post a Comment