সংক্ষেপে সোহেল যা জানালেন তা হলো, ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন করার জন্য ঝোপজঙ্গল, ঘাসবন, উলুবন ইত্যাদি কাটা হচ্ছিল। একসময় মিডিয়া সেন্টারের বাঁ পাশের মাঠের লম্বা ঘাসগুলো কাটছিলেন শ্রমিকেরা। ঘাসবন যখন প্রায় উজাড়, তখন একগুচ্ছ ঘাসের ভেতর থেকে একটি প্রাণীকে দৌড়ে পালাতে দেখেন তাঁরা। কাছে যেতেই আবিষ্কার করেন ঘাসের বাসায় পাঁচটি তুলতুলে ছানা। এগুলো নিয়ে তাঁরা কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। তাঁদের শোরগোল শুনে মিডিয়া সেন্টার থেকে নেমে আসেন সোহেল। ছানাগুলোকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ফোন করেন।
দৌড়াতে দৌড়াতে আমি ভাবছিলাম, হয়তো খাটাশের বাচ্চা পেয়েছে। কারণ, ক্যাম্পাসে খাটাশ (Civet) আছে। কিন্তু চাক্ষুষ দেখার পর বুঝলাম, এরা খাটাশ নয়, বনবিড়ালের ছানা। বয়স ১০-১২ দিনের বেশি হবে না।
এর আগে বাউবির মূল ক্যাম্পাসের ৩৫ একর জায়গায় বানর, শিয়াল, বেজি, ইঁদুর, অঞ্জন, সাপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির রেকর্ড করেছেন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সমিতির (প্রজীসস) সদস্যরা। যার সভাপতি আমি। ক্যাম্পাসে এবার বনবিড়ালের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেল। পাঁচটি ছানার শরীরের মাপ নেওয়া হলো। পাঁচ সেন্টিমিটার লেজসহ দেহের মাপ ২২ সেন্টিমিটার ও ওজন ৪৫০ গ্রাম করে। বাচ্চাগুলোর মধ্যে দুটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে।
এরপর আরেক সমস্যায় পড়া গেল। বাচ্চাগুলো কীভাবে বাঁচানো যায়। আমি ক্যাম্পাসে থাকি না। সোহেল আমাকে চিড়িয়াখানায় যোগাযোগ করতে বললেন। তিনি যেহেতু ক্যাম্পাসে থাকেন, তাই শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা না হলে তিনি এগুলোর দায়িত্বও নিতে চাইলেন। আমি ফোন করলাম বন্ধু এবং পাখি ও বন্য প্রাণীবিশেষজ্ঞ শরীফ খানকে। তিনি খবরটা শুনে খুশি হলেন এবং নিশ্চয়তা দিয়ে জানালেন, লোকজন বিরক্ত না করলে সন্ধ্যার পর মা এসে ছানাগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যাবেই। তাঁর পরামর্শে আমি ও সোহেল শ্রমিকদের সহযোগিতায় কাটা ঘাস জড়ো করে বাচ্চাগুলোকে সেখানে রেখে দিলাম। খানিক পরই ছুটে এলেন এস্টেট অ্যান্ড ক্যাম্পাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক আবদুর রশিদ। তিনিই ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাসায় ফেরার আগে ক্যাম্পাস প্রহরায় নিয়োজিত আনসারদের বলে এলাম, ছানাগুলোকে কেউ যেন বিরক্ত না করে বা এদিকে লোকজন যেন না যায়। তাঁরা যেন কড়া পাহারা দিয়ে রাখেন। আর সোহেল তো রইলই।
বাসায় গেলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে রইল ক্যাম্পাসে। সকালে এসেই খবর নিলাম ছানাগুলোর কী হলো। আনসাররাও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা জানালেন, সন্ধ্যার আবছায়া নেমে আসতেই মা-বিড়ালটি এসে একে একে ঘাড় কামড়ে ধরে ছানাদের সরিয়ে নিয়ে গেছে। দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম।
এরপর অধ্যাপক রশিদ ও প্রজীসসের সদস্যরা মিলে বনবিড়াল রক্ষার উদ্যোগ নিই। বাউবির স্কুলের পেছনের জঙ্গলটা তাদের জন্য রেখে দেওয়া হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের সৃষ্ট সেই একচিলতে অভয়ারণ্য বনবিড়ালেরা ঠিকই চিনতে পারল। ওরা ওখানে অবস্থান করতে লাগল। গতবছর বাউবির চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে আমি ও প্রজীসসের সদস্যরা প্রায় ১২ বার বাচ্চাসহ বনবিড়ালের পরিবারটি দেখেছি। এর পরও সব সময়ই এদের খবর নিই। ওরা বেঁচে আছে। কামনা করি, বংশধরদের নিয়ে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।
বনবিড়াল (Jungle Cat) এদেশে জংলি বিড়াল বা ‘ওয়াব’ নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Felis chaus. বন ও পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও গ্রামের ঝোপঝাড়, বাঁশবাগান, খেতখামার, পানের বরজ প্রভৃতিতে আনাগোনা করে। এক সময় দেশে এদের প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত। এরা পোষা বিড়ালের থেকে বেশ বড়। লেজসহ ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা, ওজন পাঁচ-ছয় কেজি। দেহের রঙে ধূসর ও বাদামি বা হলুদের মিশ্রণ। গায়ে কোনো ডোরা নেই। লেজে কতক কালো রিং দেখা যায়। চার পায়ের ভেতরের দিকে ডোরার মতো আছে। সকাল ও সন্ধ্যায় খাবার সংগ্রহ করে। ইঁদুর, পাখি, ব্যাঙ, পোকামাকড় ইত্যাদি প্রধান খাদ্য। তবে প্রাকৃতিক খাবারের সংকট হলে বসতবাড়ি বা গোয়ালঘরের আশপাশে এলে দু-একটা হাঁস-মুরগি শিকারের লোভ সামলাতে পারে না। আর তাই মানুষের রোষানলে পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারায়। এরা অত্যন্ত সাহসী। নিঃশব্দে চলার ক্ষেত্রে জুড়ি মেলা ভার। বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। তুখোড় শিকারি এই প্রাণীটি এখনো সারা দেশেই কমবেশি আছে। তবে দুঃখজনক হলো, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে এদের সংখ্যা।
প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment