ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে ভাবনা নেই, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাই সে দলের পক্ষে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সমস্যা হলো প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকানদের নিয়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাঁদের দাবি ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁদের ‘হট লাইন’ রয়েছে। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, এ নিয়ে তাঁদের নাকি হরহামেশাই বাৎচিত হয়ে থাকে। গোড়াতে প্রায় এক ডজন সম্ভাব্য প্রার্থী প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন, মিশেল বাখম্যান, ঈশ্বরের নির্দেশে প্রতিযোগিতায় নামার পর সুবিধা না করতে পেরে কেটে পড়েছেন। যে চারজন প্রার্থী এখনো নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করে যাচ্ছেন, তাঁদের সবারই দাবি, ক্ষমতায় এলে ধরাধামে ঈশ্বরের নির্দেশ মোতাবেক পাহাড় চূড়ায় আলোকোজ্জ্বল নগর গড়ে তুলবেন।
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে মারকুটে ঈশ্বরপ্রেমী ভদ্রলোকের নাম রিক সান্টোরাম। পেনসিলভানিয়ার এই সাবেক সিনেটরের স্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি নিজে চাননি রিক নির্বাচনে নামুক। কিন্তু যখন বোঝা গেল খোদ ঈশ্বরের কাছ থেকে সিগন্যাল আসছে, তখন রাজি না হয়ে তাঁর উপায় ছিল না। রিকের কাছে এই নির্দেশ কীভাবে এল—গায়েবি আওয়াজে, ই-মেইলে, ফ্যাক্সে না টেলিফোনে তা অবশ্য জানা যায়নি। পাঠক হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, যে ঈশ্বর মিশেল বাখম্যান ও রিক সান্টোরামকে নির্বাচনে দাঁড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি এক ও অভিন্ন কি না। যদি হয় তা হলে তিনি এত ঘন ঘন মত বদলান কেন, সে প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক হবে না।
সান্টোরামের দাবি, শয়তান এখন আমেরিকার ওপর ভর করেছে। এ শয়তান দূর করতে হলে চাই তাঁর মতো সাচ্চা খ্রিষ্টান নেতা। নামে না বললেও কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যে শয়তানের কথা তিনি বলেছেন, তিনি আর কেউ নন, প্রেসিডেন্ট ওবামা। রিকের দাবি, আমেরিকার ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে ওবামা ও তাঁর সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একা রিক সান্টোরাম নন, প্রতিটি রিপাবলিকান প্রার্থীই এই অভিযোগ তুলেছেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেছেন, সম্প্রতি ওবামা স্বাস্থ্যপরিচর্যার কাজে নিয়োজিত এমন ক্যাথলিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানসহ সব হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মেয়েদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহ করার যে নির্দেশ দেন, তা সরাসরি তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর আক্রমণ। অবশ্য পরে, ক্যাথলিকদের প্রতিবাদের মুখে, ওবামা সে আইন বদলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহের ভার ছেড়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিমা সংস্থার ওপর। অধিকাংশ ক্যাথলিক সংস্থা তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও রিপাবলিকান আয়াতুল্লাহদের নাখোশভাব কমেনি। ওবামাকে আক্রমণ করে তাঁরা খুতবা দিয়ে চলেছেন, শয়তানের প্রভাবে উন্নাসিকতা, গর্ব ও যৌনতার আক্রমণে আমেরিকা এখন জর্জরিত। এই ভয়াবহ পাপের সাগর থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই পথ: ওবামাকে হটানো ও তাঁদের একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন।
রিপাবলিকান প্রার্থীদের ধর্মকে রাজনীতির ভেতর টেনে আনার এই চেষ্টা নতুন কিছু নয়। দলের সবচেয়ে কট্টর ও রক্ষণশীল অংশকে কাছে টানার জন্য কম-বেশি সব রিপাবলিকান প্রার্থী আগেও এই কাজ করেছেন। কিন্তু এবারের প্রচারণার একটি লক্ষণীয় দিক হলো, নারী অধিকারবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। গর্ভপাত বা জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয় অনেক আগেই মীমাংসিত হয়ে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়ে গর্ভপাত আইনসম্মত করেছে। এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে এ দেশে ৯৯ শতাংশ মহিলা তাঁদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সবাই রয়েছেন, কোনো না কোনো রকম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। খোদ রোমের পোপ পর্যন্ত এইডস বা অন্যান্য ভয়াবহ রোগ ঠেকাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকার রিপাবলিকানরা যেভাবেই হোক ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। গর্ভপাতের আইন এই মুহূর্তে বদলানো না গেলেও চেষ্টাচরিত্র চলছে কীভাবে সে সুযোগ সংকুচিত করা যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ কাটছাঁট করা সে কর্মকৌশলেরই অংশবিশেষ।
গর্ভপাতকে অনৈতিক প্রমাণের যে চেষ্টা আমেরিকায় চলছে তা দেখে আমাদের মাথা চুলকানো ছাড়া আর উপায় নেই। পৃথিবীর সব দেশেই এমনকি বাংলাদেশেও মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এ বিষয়েও নীতিগত মতৈক্য রয়েছে যে গর্ভপাতের সঙ্গে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই—এর সম্পর্ক মেয়েদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে। তার চেয়েও বড় কথা, মেয়েদের নিজেদের শরীর নিয়ে যে সিদ্ধান্ত, তা ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁরা নিজেরা নেবেন, সব সভ্য দেশেই এই অধিকার এখন স্বীকৃত। অথচ আমেরিকায় মেয়েদের হাতে সে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়ার বদলে রাজনৈতিক নেতারা দাবি করছেন তাঁরাই ঠিক করবেন কোনটা ঠিক, কোনটা নৈতিক। এসব নেতার মধ্যে দুচারজন এমন লোক আছেন যাঁরা জামা বদলানোর মতো বউ বদলান। নৈতিকতা নিয়ে কথা বলার সাহস তাঁরা পান কী করে?
আমেরিকার রিপাবলিকান রাজনীতিতে অতি কট্টর ইভানজেলিক্যালদের প্রভাবের কথা সুপরিচিত। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় থেকেই বাইবেল হাতে নিয়ে রাজনীতি করার উপদ্রব। সে সময় এক ইভানজেলিক্যাল নেতা জেরি ফালওয়েল মর্যাল মেজরিটি নামে দল গঠন করে রিগ্যানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। গত ২০ বছরে দল হিসেবে মর্যাল মেজরিটি বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়লেও রাজনৈতিকভাবে তাদের গুরুত্ব কমেনি। বস্তুত, রিপাবলিকান দলের মধ্যে এই অতি দক্ষিণপন্থী অংশের প্রভাব এখন আগের চেয়েও বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ দেশের মোট ভোটারের ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশ হয় নিজেদের ইভানজেলিক্যাল মনে করে অথবা রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল। এদের প্রায় সবাই নিজেদের রিপাবলিকান বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। ওবামার নির্বাচনের প্রতিক্রিয়ায় ২০১০ সালে যে তথাকথিত ‘টি-পার্টি’ আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার সিংহভাগ সমর্থন আসে এই ইভানজেলিক্যালদের কাছ থেকে।
অনেকেই ভেবেছিল নভেম্বরে নির্বাচনে একমাত্র আলোচ্য বিষয় হবে অর্থনীতি। কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতি খুব ধীরগতিতে হলেও সংকট উত্তরণের পথে। বেকারত্ব কমছে, নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়ছে। এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে রিপাবলিকান প্রার্থীরা অর্থনীতি ছেড়ে নজর দিয়েছেন সামাজিক সমস্যায়। টেনে এনেছেন ঈশ্বর ও শয়তানকে। ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এ দেশে সাদা-কালোর মধ্য বর্ণবাদী উত্তেজনা বেড়েছে। বহিরাগত, বিশেষ করে মুসলমান ও হিস্পানিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণের সংখ্যাও বেড়েছে। বিরোধী রিপাবলিকান দল ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন তাঁরা ওবামার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন না। তাতে দেশের যদি বারোটা বাজে তাতেও ক্ষতি নেই। এর ওপর এখন যদি ধর্মীয় প্রশ্ন তুলে নতুন আরেক বিভাজনরেখা এঁকে দেওয়া হয়, তা হলে এ দেশের রাজনৈতিক বিভক্তি আরও বাড়বে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন বছর কাটানোর পর এখনো এমন অনেক লোক আমেরিকায় আছে যারা মনে করে ওবামা আসলে মুসলমান। তিনি এ দেশে জন্মগ্রহণ করেননি, ফলে তাঁর প্রেসিডেন্সি অবৈধ, এমন দাবি করে, এমন লোকেরও অভাব এ দেশে নেই। স্পষ্টতই রিপাবলিকান দলের নেতারা এই ওবামাবিরোধী মনোভাব নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান। যেমন রিক সান্টোরাম সরাসরি বলেই বসেছেন, ওবামা খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তাঁর বিশ্বাস ‘ফালতু এক ধর্মতত্ত্ব’। আরেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ন্যুট গিনগ্রিচ, তিনিও বলেছেন, ওবামা বাইবেলের চেতনার পরিপন্থী কাজ করে চলেছেন। এসব বক্তব্যের আসল লক্ষ্য এ দেশের অতি-কট্টর বাইবেলপন্থী রিপাবলিকান ভোটার, যাদের অনেকেই ওবামার প্রেসিডেন্সিতে অসন্তুষ্ট। অথচ ওবামা নিজে বলেছেন তিনি খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টীয় মতে তাঁর বিয়ে হয়েছে। নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যে চার্চে যাওয়া-আসা করেন। তার পরও এই সন্দেহ।
আমার পক্ষে বোঝা কঠিন, আমেরিকার মতো দেশে ধর্ম নিয়ে এই রাজনীতি এখনো কীভাবে টিকে থাকে। অনুন্নত বা অনগ্রসর দেশে ধর্মের প্রভাব কতটা প্রবল তা আমরা জানি। কিন্তু আমেরিকা তো অনুন্নতও নয়, অনগ্রসরও নয়। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে অনেক দিন থেকে ধর্মের প্রতিষ্ঠানিক গুরুত্ব কার্যত নেই। ধর্মগুরুদের মুখ চেয়ে কেউ সেখানে তাদের ভোটের সিদ্ধান্ত নেয় না। কিন্তু আমেরিকায় ব্যাপারটা একদম উল্টো। এ দেশে রেডিও টক শো বলে একটা জিনিস আছে। রেডিওর নব ঘোরালেই কানে আসে ধর্মব্যবসায়ীদের চিৎকার। এদের সঙ্গে যোগ করুন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মেগা চার্চ। এদের প্রভাবে কোনো কোনো রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের বাইরে বিন্দুমাত্র কথা বলা যাবে না। চার্চের প্রচারণার কারণে টেক্সাস বা আলাবামায় এমন লোকের অভাব নেই যারা এখনো বিশ্বাস করে পৃথিবী আসলে গোল নয়, সমতল। এদের মন জোগাতেই রাজনীতিকেরা স্টেম সেল নিয়ে গবেষণায় কোনো রকম সরকারি সাহায্যের বিরোধী। দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনেক রাজ্য আছে, যেখানে চেষ্টা চলছে স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ দিতে। ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা নিয়েও এরা সন্দেহ প্রকাশ করে কোনো রকম বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ছাড়াই।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য ধর্ম নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা এক ধরনের সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ধর্মকে পুরোপুরি নাগরিক জীবন ও রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই, কারণ এখনো অধিকাংশ মানুষ ধর্মপরায়ণ। ধর্মকে উপেক্ষা করার কারণে ডেমোক্র্যাটরা একসময় উন্নাসিক/অ্যালিটিস্ট বলে গাল খেয়েছিল। ধর্মকে সর্বতোভাবে পরিহারের চেষ্টায় কোনো কোনো ডেমোক্র্যাট নেতা সাধারণ ভোটারদের কোপানলে পড়েছেন, তা স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে চেষ্টা চলছে বিশেষত বিল ক্লিনটনের সময় থেকে ধর্মকে সরাসরি রাজনীতির অঙ্গীভূত না করে ব্যক্তিগত জীবনচর্চায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করা। অন্য কথায়, ব্যক্তি হিসেবে আমি ধর্ম পালন করব, কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করব না।
এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ জাতীয় নীতি গ্রহণের ফলে ইভানজেলিক্যালদের শিবিরে কোনো ভাঙন ধরেছে, এমন কথা শুনিনি। তবে ডেমোক্র্যাটরা তাদের চেহারায় কিঞ্চিৎ হলেও আতরের খুশবু মাখাতে পেরেছেন। নিদেনপক্ষে, ডেমোক্রেটিক নির্বাচনী কৌশলবিদদের তা-ই বিশ্বাস।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment