যুগ যুগ ধরে প্রেমপাগল মানব-মানবী ও তরুণ-তরুণী বসন্তকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি আর আয়োজনে এই দিনটিকে বরণ করছে এবং বসন্তের স্তুতি গেয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। প্রেমিকার মতোই বসন্ত আলোড়ন তোলে, ঢেউ খেলে, নোঙর জাগায় কবির হৃদয়ে। তাই কবি সেই স্বপি্নল আবেগের কথা তুলে ধরেন কবিতার ছন্দে। এমনি একদিন একজন কবির কবিতার পাতায় ফুটে উঠেছে_ ফুল ফুটুক, না ফুটুক আজ বসন্ত।
বসন্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাস। বসন্ত আগমন বার্তা পাওয়ার পর পরই প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে মেলে তার রূপকে। বসন্তে দেখা মেলে প্রকৃতির বাহারি ফুলের
সমাবেশ। এজন্য বসন্তকে বলা হয় ফুলের মাস। গাছে গাছে ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় প্রকৃতি। নির্মল ঘ্রাণে মোহময় থাকে তরুণ-তরুণী আর প্রকৃতির সৌন্দর্যপিয়াসীরা। প্রকৃতির সোভা ফুল আর বসন্ত যেন একে অপরের পরিপূরক।
পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার ফুলের সৌরভে বসন্ত হয়ে ওঠে ছন্দময়। মোহাচ্ছন্ন থাকে তরুণ-তরুণীর হৃদয়। তবে কৃষ্ণচূড়া যেন বসন্তের প্রতীক হয়ে বিকশিত হয় প্রকৃতিতে।
‘ নওরোজ’ অর্থ নতুন দিন। প্রাচীন ইরানের উৎসব এটি। বসন্তের প্রথম দিনটিকেই গণ্য করা হয় বছরের প্রথম দিন হিসেবে। ইরানি পঞ্জিকা মতে সাধারণত এই উৎসব আয়োজন করা হয় ২১ মার্চ। এর আগ-পিছুও হয় মাঝে মাঝে।
প্রাচীন গল্পে দেখা যায় ইরানের বাদশাহ জমশেদ এই উৎসবের প্রচলন শুরু করেন। বছরের এই দিনে জমশেদের অধীনস্থরা জড়ো হতো তার সিংহাসনের চারপাশে। ছড়িয়ে দিত মণি-মুক্তা। রাজার শুভকামনা করে জয়ধ্বনি দিত। আর বলত আজ থেকে শুরু হলো নতুন দিন বা ‘নওরোজ’।
প্রায় তিন হাজার বছর ধরে উদযাপিত এই উৎসবের উৎপত্তি ইরানে হলেও ‘নওরোজ’ আজ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, চীনের উত্তর-পশ্চিম ও ইউরোপের বলকান অঞ্চলে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নওরোজ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সেই সপ্তম শতাব্দীর কথা। সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বসন্তের এমন দিনে বাড়ির বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় গা ভাসাতে ভালোবাসতেন। এ সময় পুরো দেশটাই যেন ছেয়ে যায় চেরি ফুলে। প্রকৃতিতে দেখা দেয় অপরূপ রূপময়তা।
জাপানিরা চেরি ফুলকে ‘সাকুরা’ বলে ডাকে। এই উৎসবকে ডাকে ‘হানামি’ বলে। এই গাছ কোরিয়া, চীনসহ অনেক দেশে জন্ম নিলেও জাপানে রয়েছে প্রায় চারশরও বেশি প্রজাতি।
হানামিতে আয়োজন করা হয় নানারকম অনুষ্ঠানের। এতে ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশেছে আধুনিক ভাবনা। জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে সাকুরা জানুয়ারিতেই ফুটতে শুরু করলেও হানামির মূল আয়োজনটা শুরু হয় মার্চ মাস থেকে।
চীনেও বছর শুরু হয় বসন্তের প্রথম দিনে। তাই ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর ভেতর এটি প্রধান। চীনে যেহেতু চান্দ্র মাসের হিসাব, তাই ঋতুর চেয়ে চাঁদের চেহারাটা একটু বেশি প্রাধান্য পায়। তবে নতুন চাঁদের মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এই মোচ্ছব। তারপর টানা পনের দিন চলে মউজ-মাস্তি।
প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে আয়োজন করা হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রূপকথা। তবে সব অঞ্চলেই ঘটা করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় ঘরদোর। দূর করে দেওয়ার চেষ্টা চলে পুরোনো জঞ্জাল। কেনা হয় নতুন জামা। শুরু করা হয় নতুন জীবন।
হোলি উৎসব হলো রঙের উৎসব, হিন্দি ছবি দেখে তা-ই শেখা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে বা মার্চের শুরুতে হয় এই উৎসব। তারিখটি নির্ভর করে চাঁদের ওপর। এই বসন্ত উৎসব ভারত ও এর আশপাশের অঞ্চলে উদযাপিত হয়।
ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, একদিন অসুর হিরণ্যকশিপু আক্রমণ করে বসল স্বর্গলোক। অবতার বিষ্ণু নরসিংহের রূপে এসে হত্যা করল এই অপদেবতাকে। রক্ষা পেল স্বর্গ। সেই শুভ দিনটিকে এই অঞ্চলে স্মরণ করা হচ্ছে স্মরণাতীত কাল থেকে। এই বছর হোলি উদযাপন করা হবে ২০ মার্চ।
সক্রান বা জল ছিটানো উৎসবে থাইল্যান্ড জেগে ওঠে নতুন চেহারায়। তিন দিনব্যাপী এই উৎসব শুরু হয় ১৩ এপ্রিল। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক মিল। বাংলা ‘সংক্রান্তি’ শব্দটিই শ্যামদেশে ‘সক্রান’।
প্রথা অনুযায়ী, এই উৎসবে জল ছিটানো হয় শরীর ও মনের কালিমা দূর করার বাসনা নিয়ে। জলে ভিজে মানুষগুলো নিজেকে পবিত্র করে নেয়। ধুয়ে ফেলে গেল বছরের তিক্ততা।
এই উৎসবের সঙ্গে যুগে যুগে যোগ হয়েছে বিভিন্ন আচার। তবে নিয়ম করেই যাওয়া হয় মন্দিরে। ধর্মের কাছে, বুদ্ধের ও সংঘের কাছে চাওয়া হয় আশ্রয়। তবে শুধু ধর্মের ভেতরেই আবদ্ধ নেই এই উৎসব। পর্যটনপ্রধান শহরগুলোতে আয়োজন করা হয় অনেক ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক অনুষ্ঠান।
0 comments:
Post a Comment