বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশের আগের দিন গতকাল রোববার রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিল হরতালের মতো। এর আগের দিন শনিবার থেকে বাইরের জেলার সঙ্গে রাজধানীর সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আর গতকাল ঢাকার ভেতরেও গণপরিবহন প্রায় বন্ধ ছিল।
যানবাহনের পাশাপাশি আবাসিক হোটেলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বাইরের জেলা থেকে ঢাকায় চিকিৎসাজনিত, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো কাজে আসা ব্যক্তিরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও নগরবাসী এ অবস্থাকে নজিরবিহীন হিসেবে মন্তব্য করেছেন। অতীতে বিরোধী দল হরতাল ডাকলে সরকারের পক্ষ থেকে যানবাহন চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হতো। কিন্তু এবার বিরোধী দলের ১২ মার্চের মহাসমাবেশ উপলক্ষে সরকারই ঢাকা এবং মহাসড়কগুলো প্রায় অচল করে দিয়েছে।
আজ সোমবারও এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবহন খাতের লোকজন জানিয়েছেন।
বিএনপির অভিযোগ, তাঁদের মহাসমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে সরকার নিজেই রাজধানী ঢাকাকে অচল করে দিয়েছে। চারদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে গত শনিবার থেকেই রাজধানীর সঙ্গে সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি প্রবেশমুখে ও মহাসড়কে চৌকি বসিয়ে ঢাকামুখী গাড়ি আটকে দেওয়া হচ্ছে। আর সর্বশেষ গতকাল সকাল থেকে ঢাকার ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের ব্যবস্থাও অচল করে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিছু গাড়ি কম চলেছে। এটা খুবই সাময়িক, এক-দুই দিনের ব্যাপার।’ তিনি দাবি করেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে সরকার যানবাহন বন্ধ করে দেবে। বিরোধী দলের হুমকি-ধমকির কারণে কিছু মালিক হয়তো যানবাহন বন্ধ রেখেছেন।
এদিকে, গতকাল ঢাকায় ১৪ দলের মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে, তাদের নেতা-কর্মীরা আজ মাঠে থাকবেন। দলটির দাবি, বিরোধী দল যাতে কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড না ঘটাতে পারে, সে জন্য ঢাকার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সরকারি দলের কর্মীরা সতর্ক অবস্থান নেবেন। দলীয় সূত্র জানায়, নয়াপল্টন ছাড়া ঢাকার আর কোথাও বিএনপিকে জমায়েত হতে দেবে না আওয়ামী লীগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী দলের ১২ মার্চের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও উত্তাপ ছিল।
গণগ্রেপ্তার: সর্বশেষ গত দুই দিন ঢাকার প্রবেশমুখ, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়, রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং সারা দেশে গণগ্রেপ্তার জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীসহ ২৮টি জেলায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৯৯৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৩১ জনকে।
অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তল্লাশির নামে হয়রানির অভিযোগ করেছেন। বাইরের জেলা থেকে ঢাকামুখী অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত তল্লাশির বাইরে থাকছে না।
ঢাকার রাস্তায় বিজিবি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি নামানো হয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদেরও। গতকাল রাতে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পিকআপ ভ্যানে বিডিআর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়।
বিজিবি সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় বিজিবির সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন। বিশেষ করে সচিবালয়, কূটনৈতিক পল্লি, বিমানবন্দর—এসব এলাকায় বিজিবির সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।
এখনো লঞ্চ বন্ধ: দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী লঞ্চ আগের দিনই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পরও আগের রাতে ছেড়ে আসা দু-একটি লঞ্চ গতকাল সকালে সদরঘাটে ভেড়ার পরপর যাত্রীদের ওপর হামলা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগ।
গণপরিবহনের স্বল্পতা: ঢাকার ভেতরেও বাস চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। অফিস শেষে বাড়িমুখী মানুষ যানবাহনের অভাবে দুর্ভোগে পড়েন। বিআরটিসির অল্প কিছু বাস চলাচল করেছে, তবে সেগুলোতে বিভিন্ন গন্তব্যে থামামাত্র মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এ ছাড়া যাতায়াতের জন্য রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশাভ্যান ও পিকআপ ভ্যানই ছিল ভরসা। বেলা সোয়া একটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকটি বাস শাহবাগের দিকে যাওয়ার সময় চারুকলা অনুষদের সামনে সেগুলো আটকে দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।
জ্বালানিবাহী ট্যাংক-লরির চলাচল বন্ধ থাকায় রাজধানীতে বিভিন্ন পাম্পে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে।
অতীতে দেখা গেছে, বিরোধী দল হরতাল ডাকলে সড়ক পরিবহন খাতের সরকার-সমর্থক নেতারা যেকোনো মূল্যে যানবাহন চালু রাখার ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি ও বিবৃতি পাঠাতেন। এবার এর উল্টো হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহাসমাবেশের দিন বিএনপির ইন্ধনে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হতো। তাঁরা এবার সেটা করেননি। সরকার-সমর্থক এই পরিবহন নেতা দাবি করেন, আতঙ্কের কারণে মালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন।
অঘোষিত ছুটি: বিএনপির মহাসমাবেশের কারণে আজ রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অঘোষিত ছুটি থাকবে বলে জানা গেছে। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নোমান-উর রশীদ প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনা করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে থাকতে পারে।
গতকাল সচিবালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অঘোষিতভাবে বিকেলের পরই ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যান।
নিথর বাস টার্মিনালগুলো: গতকাল সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি বাস নিথর দাঁড়িয়ে আছে। নেই যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের কোনো হাঁকডাক। কিছু বাসে চালক ও শ্রমিকদের বসে গল্পগুজবে মশগুল থাকতে দেখা গেছে।
একাধিক চালক ও বাস কোম্পানির ব্যবস্থাপকেরা জানান, স্থানীয় সাংসদের লোকজন গত শনিবার বিকেলেই বাস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ঢাকা-কুমিল্লা পথের তিশা পরিবহনের চালক আল আমিন বলেন, ‘ট্রিপের (যাত্রা) ওপর আমাদের বেতন। বাস বন্ধ বলে বেতনও বন্ধ। হরতাল হলেও আমরা টুকটাক বাস চালাই। কিন্তু আজ কোনো বাসই চলেনি।’
সায়েদাবাদ জনপথের মোড় থেকে মানিকনগর পর্যন্ত কয়েক শ পরিবহন কোম্পানির টিকিট কাউন্টার বন্ধ পাওয়া গেছে। সেখানে কথা হয় লক্ষ্মীপুর থেকে আসা শাহ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত শুক্রবার চিকিৎসা নিতে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। এখন যেতে পারছেন না।
মিজানুর রহমান ও মনিরুজ্জামান সিলেটে যাওয়ার জন্য শ্যামলী পরিবহনের একটি কাউন্টারে গেলে তাঁদের কমলাপুর থেকে ট্রেনে যাওয়ার পরামর্শ দেন ওই কাউন্টারের ব্যবস্থাপক। মিজানুর রহমান ও মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনেরও টিকিট পাননি তাঁরা।
গাবতলীতেও ছিল একই চিত্র। এখান থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। বেলা তিনটায় গাবতলীতে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী পারভীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাতটায় সুরভী পরিবহনে করে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে জরুরি ভিত্তিতে পটুয়াখালীতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস ছাড়ার পরপর পরিবহন মালিক সমিতির লোকজন এসে বাস বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়। এরপর বাস বন্ধ করে যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘লঞ্চেও যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই অপেক্ষায় আছি, কোনো বাস যদি পাওয়া যায়।’
ঢাকায় সরকারি কাজে এসে পুলিশের সদস্য এখলাস উদ্দিনও নিজ গন্তব্য কুষ্টিয়ায় যেতে পারেননি। তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকারি কাজেই কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। এখন ফিরেও যেতে পারছি না।’
মহাখালী বাস টার্মিনালে সব বাস কাউন্টার বন্ধ ছিল। সেখানে পুলিশি পাহারাও দেখা গেছে। ময়মনসিংহগামী কিছু যাত্রী বাসের আশায় অপেক্ষা করছিল। একপর্যায়ে শ্রমিক ইউনিয়নের নাম করে কিছু লোক ওই সব যাত্রীকে তাড়িয়ে দেয়।
দিগন্ত পরিবহনের শ্রমিক ফজলুল হক বলেন, সকালে যাত্রীদের কাছে ২৫০ টাকা করে নিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে বাস ছাড়া হয়েছিল। খবর পেয়ে পরিবহন মালিক সমিতির লোকজন এসে তা বন্ধ করে দেয়।
ট্রেনে ছিল না বাড়তি বগি: গতকাল ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। তবে কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল টিকিটের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের সময় যে ধরনের ভিড় হয়, এবারও তা-ই হচ্ছে।
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আন্তনগর ট্রেনে বাড়তি বগি সংযোজন বন্ধ রাখা হয়েছে গত শনিবার থেকে। স্বাভাবিক সময়ে যাত্রীচাহিদা বিবেচনা করে যাত্রার আগের দিন বিভিন্ন আন্তনগর ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা হতো।
এ ছাড়া রেল ভবন থেকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী, ট্রেন পরিচালনায় জড়িত ও স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিএনপির মহাসমাবেশ এবং নাশকতার বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন: গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করেন, বিরোধী দলের কর্মসূচি সামনে রেখে যান চলাচলে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক ভাইরাই এ কথা বললেন; কিন্তু লঞ্চ, বাস বা হোটেলের মালিকদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা বলা হয়নি। পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। গাড়ি বা হোটেল বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব নয়; বরং তাদেরকেই (লঞ্চ, বাস বা হোটেলের মালিক) জিজ্ঞাসা করুন, কেন তাঁরা বন্ধ রাখছেন।’prothom-alo
0 comments:
Post a Comment