বিশ্বজুড়ে দর্শন শাস্ত্রবিদদের নামের তালিকায় গুরু সক্রেটিসের পাশাপাশি প্লেটোর (জন্ম ৪২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) নাম সমান দ্যুতিতে দেদীপ্যমান। ওই যুগের অপর মহীরূহ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটোর বহুল আলোচিত নানামুখী দর্শন ও মতবাদের মধ্যে ‘প্লেটোনিজম’ একটি। সময়ের পরম্পরায় দেহলেশহীন প্রেমের সাথে এই দার্শনিকের নাম জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।
পরবর্তীতে প্লেটোর মতবাদ ‘প্লেটোনিজম’ থেকেই প্রেমের একটি পর্যায়ের নামকরণ করা হয়েছে প্লেটোনিক লাভ বা প্লেটোনিক প্রেম। যে প্রেমে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোসার গভীরে অবগাহন করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটির কোনও প্রকার উপস্থিতি থাকবে না- প্লেটোর মতবাদ অনুসারে মুলতঃ প্লেটোনিক প্রেমের সজ্ঞা এমনটাই।
তার মানে কি এই যে, সুদূর অতীতে এই গ্রিক দার্শনিকই সর্বপ্রথম ভালোবাসার রাজ্য থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন শরীরকে?
প্লেটোর দর্শনের একাংশে অবশ্যই শরীরবিহীন এক অদৃশ্য প্রেমের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্রেম ঠিক মোটাদাগের প্রেমের তত্ত্বস্থাপনা নয়! তাই বিষয়টি সাধারণ চোখে শুধুমাত্র প্রেম বা ভালোবাসা বলে ধরা হলেও এর অভ্যন্তর বেশ জটিল আর বাইরের দেয়ালও নানা আবরণে আচ্ছাদিত। অর্থাৎ মন-মগজ আর শারীরিক প্রেমের পাশাপাশি যে প্রেমে শরীর বিষয়টি অনুপস্থিত অথচ প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় ষোল আনা, প্লেটো ঠিক এমন এক প্রেমানুভূতিকে পৃথকভাবে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
এটি আসলে ভালোবাসারই একটি মূল উপাদান বা অনুভূতির নাম যা কম বেশি সব প্রেমিক প্রেমিকাই তার প্রেমপর্বের কোনও একটা সময় এসে উপলব্ধি বা অনুভব করেন। তখন প্রেম তার কাছে ধরা দেয় দেহলেশহীনভাবে, তার মগজ ও মনে তখন সেই প্রেম এসে বাসা বাঁধে এক অদৃশ্য ইমেজ বা ছায়ারূপে। আর সেই ইমেজ এতটাই দৃঢ়ভাবে হৃদয়ে প্রথিত হয় যে শুধুমাত্র প্রেম নামক একবিন্দু অনুভুতিকেই স্বর্গ বলে ভাবতে শুরু করে প্রেমিকরা। তবে; প্রেমের এই আবহ সৃষ্টি হয় প্রেমের ডিসকভারি পিরিয়ড বা প্রাথমিক স্তরেই। মহামতি প্লেটোর দর্শনে ঠিক এমন আবহ সৃষ্টির সময় ও প্রেমানুভূতিকেই মূলতঃ অভিহিত করা হয়েছে ‘প্লেটোনিক প্রেম’ (বায়বীয় প্রেম!) হিসেবে।
প্লেটোনিক প্রেমের শুরু বা ডিসকভারি পিরিয়ডে এদেশের লাইলী-মজনুর কাহিনী কিংবা বিদেশের রোমিও-জুলিয়েট এমনকি একেবারে আমাদের মত মানুষের প্রেমেও একটা বিষয় কমন। তা হলো, শুরুতে আমাদের প্রেমের সাথে শরীরের যোগটা একেবারেই থাকে না।
সময়সীমার ভিন্নতা হলেও প্রেমের অন্যান্য উপাদানগুলো অবশ্য যথার্থ বিদ্যমান থাকে। তখন আমরা প্রেমিক-প্রেমিকাকে বুঝে ফেলার পাশাপাশি আবিষ্কার করি-সময় বড় বেশি দ্রুত ধাবমান, রক্তচোষা স্কুটারচালকেরাও কত মহান, ঝালমুড়ি-চটপটির মত আদর্শ খাবার আর নেই, কবিতাই হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়, কোন কোন গান শুনে মনে হয় নিজের জীবনের ঘটনাই যেন সুর হয়ে বাজছে, চারপাশের প্রকৃতি কত মনোরম এমন আরো কত কি।
বর্তমানে প্রেমের এসব উপাদান ও প্রক্রিয়াতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকারা তাই ভালোবাসার মানুষটির সাথে দেখা হবার পর ভাবতে শুরু করে- মোবাইল কল কেন ফ্রি হয় না, ইন্টারনেটে কেন সারাটা সময় তাকে পাওয়া যায় না, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে’র মত দিনগুলো কেন বারবার আসে না আর সর্বোপরি ‘সে হীন জীবন সত্যি মরুভূমি!’ অথচ, তার সাথে দেখা হওয়ার আগে এসব সম্পর্কে কী উল্টো ধারণাটাই না ছিলো!
প্রেমের এই সময়ে শরীর নয় মনই সব। নিজের মনটাকে অন্যের হৃদয়ের গভীরে তখন কেবল আমূল সেঁধিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। এই ভালোবাসায় শরীর কোথায়? যদিও ফ্রয়েড বলেছেন- মানুষের মনে যৌন প্রকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে মাত্র ৩ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে। যদি তাই হয়, তাহলেও এই যৌনতার বহিঃপ্রকাশ তো সে সময় ঘটেই না বরং যৌন অনুভূতিও থাকে মনের অতলে ঘুমন্ত অবস্থায়। সুতরাং ফ্রয়েড সাহেবের যুক্তি এখানে খুবই নড়বড়ে! অচল!
প্লেটোর দর্শনের একাংশে এমন এক চিরন্তন সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে যা ইন্দ্রিয়াতীত। ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমের সাথে তার সংমিশ্র রূপই মানুষের চির সন্ধিৎসার বিষয়। কিন্তু এই ব্যাপক উচ্চ মানসিক প্রেম ও সৌন্দর্যকে বোঝার জন্যই মানুষকে লৌকিক প্রেমের সরোবরে অবগাহন করতে হয়। আর তখনই তার ভেতরে জেগে উঠতে থাকে পারমার্থিক আকাশে উড়ার ভাবনা। অর্থাৎ মহত্তর ‘আমি’ ক্রমে তার কাছে প্রতীয়মান হয়, যেন মর্ত্য মানবীর তুলনায় পরা প্রকৃতির রূপশ্বৈর্য কত বেশি! তখন ইন্দ্রিয়ের ছোট গ-ি পেরিয়ে, সমস্ত ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে তার জীবনে আসে নতুন দিগন্ত। নতুনের পথে তার যাত্রা হয় শুরু। বোঝা কঠিন নয়, এই ভাবনাই কাজ করেছে নিষ্কাম প্রেম সম্পর্কিত ধারনার প্রথম পাঠ হিসেবে।
রবীন্দ্র ভাবনায় পাওয়া গেছে এর পরিষ্কার প্রস্ফুটন-
‘লোভের অতীত যাহা
সুন্দর যা অনির্বচনীয়
যাহা প্রিয়।’
অর্থাৎ ভালোবাসা আর সুন্দর একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। কিন্ত; সেখানে কোনও লোভের ছোঁয়া নেই। আছে অনির্বচনীয়তা। এখানে লোভ মানে অবশ্য গ্রিড নয় ‘ইরোটিসিজম’। তবু একথা বলা যাবে না যে ধারণাটি নিছকই ধার করা বা বিদেশি। এর শেকড় আমূল প্রথিত রয়েছে এদেশের মাটিতেও। প্লেটোর অতীন্দ্রিয় প্রেমতত্ত্ব রবীন্দ্র ভাবনায় যদি বীজ হিসেবে কাজ করে থাকে তবে এক্ষেত্রে উর্বরতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে প্রাচ্য দর্শন আর বৈষ্ণব প্রেম তত্ত্ব।
কবিগুরুর পর এবার প্লেটোনিক প্রেমের আর এক অমর দৃষ্টান্ত চণ্ডীদাসের কাছ থেকে চলুন ঘরে আসা যাক। চ-ীদাসের সাথে রজকিনীর প্রেমের কথা সকলেরই জানা। সমাজ তাদের প্রেমকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে উৎপীড়ন করেছিল। অত্যাচারও কম করেনি! কেউ কেউ বলেন- সামাজিক ও বিত্তবৈভবের অসমতাই ছিল তাদের প্রেমের পথে প্রধান অন্তরায়। আর তাই তাদের প্রেমের ফল পরিণতির দিকে না গিয়ে বিচ্ছেদ-বিরহে রূপ নিয়েছে। তাদের ভাষায় এক প্রকার ব্যর্থ প্রেমের নায়ক চণ্ডীদাস।
তবে; সারকথা হলো, বৈষ্ণব পদকার বা কবি চণ্ডীদাসকে রজকিনীর সাথে তার দীর্ঘ্য বিরহী প্রেম কাহিনীকে উপলক্ষ্য করে নিন্দুকেরা যতই তামাশা করুক না কেন, চণ্ডীদাস কিন্তুকবিতায় ঠিকই তার প্রেমের ধরনটি আমাদের স্পষ্ট করেছেন -
‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম
কাম-গন্ধ নাহি তায়!’
ব্যক্তিগত জীবনে এমন ব্যথা-সুরভীত প্রেমের অভিজ্ঞতা ছিল বলেই বুঝি চণ্ডীদাসের প্রতি পদে, প্রতি ছত্রে প্রবাহিত হয়েছে রাধার নিষ্পাপ প্রেমের অশ্রুধারা!
অন্যদিকে পদাবলীর পদ যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে, সেই কৃষ্ণের তুলনায় চণ্ডীদাসও অনেক অর্বাচীন। তাই প্লেটোর সাথে সময়ের বাজীতে নিঃসন্দেহে জিতে যাবেন কৃঞ্চ। মূলত: প্রেমের তিনি ঠাকুর! প্রেমের তিনি রাজা!
ভালোবাসা চিরকালই চিরহরিৎ বনের মত, নৈসর্গিক সবুজে আবৃত এক সোনার হরিণ। সবার জীবনে তার দেখা মেলে না। আবার কারো কারো মিললেও ধরা দেয় না। বাকি জীবনে তাই অধরাকে ধরার বাসনা সুপ্তই থাকে।
আর যে ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই? সেতো দুষ্প্রাপ্য নাইট কুইন অথবা আমাজান লিলির মত একই সাথে মনোলোভা এবং ক্ষণস্থায়ী! এমন নিষ্কাম প্রেম, যে প্রেম রাজাধিরাজের মত দু’হাত ভরে শুধু দিয়ে যায়, নেয় না কিছুই। যাকে লাভ করার জন্যে দীর্ঘ্য প্রতীক্ষা আর দুঃসহ যন্ত্রণাসমূহও সহ্য করতে হয় মুখ বুজে। বিনিময়ে কখনো কখনো কপালে জোটে ব্যর্থ প্রেমিকের অপবাদ ছাপ! প্রেমের জন্য স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়- প্রেমের এমন ভয়ঙ্কর রূপের নামই তো প্লেটোনিক লাভ!
একটু ভিন্ন অভিধা ও মোড়কে জড়িয়ে আমাদের কাছে যে এক বিস্ময়কর, আশ্চর্য ভালোলাগার অনূভূতি মিশ্রিত শিরি-ফরহাদ ও লাইলী-মজনুর কালজয়ী প্রেম কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে মূলতঃ প্লেটোর দর্শিত সে প্রেমও কী শুধুই দেহলেশহীন অস্পৃশ্য এক গভীর আবেগের নাম নয়? যাকে আমরা প্রেম বলে বিবেচনা করেছি? প্লেটোনিক নামটি এখানে ভিন্ন ছাঁচে একই উপাদানে নির্মিত একটি ‘ব্র্যান্ড নেম’ ছাড়া কিছু নয়।
প্রিয়া বিরহে মজনু যখন দিওয়ানা বা পাগলপারা তখন তিনি পথে লাইলীর পালিত কুকুরকে পেলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকতেন। লোকে তার পাগলামি নিয়ে প্রশ্ন করলে সে জবাব দিতো- ‘আমি জানি এটি লাইলীর কুকুর। আমার প্রেমিকা লাইলী একে খেতে দেয়, কুকুরটি তার আশে পাশেই ঘুরঘুর করে আর লেজ নাড়িয়ে তার প্রভুর কাজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এসময় কখনো হয়তো বা কুকুরটির গায়ে লাইলীর শরীরের কোমল স্পর্শ লেগে থাকবে। তাই কুকুরটিকে চুমু খাওয়া!’
ইরানের একটি গজলের কথা এরকম-
‘কাজু বাদামের ফালির মত চাঁদের ম্লান আলোর টুকরো
জানালা দিয়ে আমার বিছানায় এসে পড়ে যখন
দূরে চিনারের বনে অসময়ে ঝড়ো হাওয়া
মাতাল হয়ে ওঠে যখন-
তখন তোমাকে খুব মনে পড়ে আমার
অথচ তোমার নাম আমার মুখে আনাও মানা!’
ইরানী এই গজলটিতে প্রেমেপড়া মেয়েটির যে তীব্র অথচ অশালীন নয় এমন আবেগের কথা শোনা যাচ্ছে, ঠিক তার মত দেহাতীত প্রেমের আবেগ জড়ানো ভাবনা আমাদের ছেলেবেলার অনেকটা সময়জুড়ে লেপটে থাকলেও এমন প্রেমকে নিজের জীবনে ভাবার সময় হয় না অনেকেরই। নাগরিক ব্যস্ততা ও আটপৌরে প্রাত্যহিকতায় ডুবতে ডুবতে অর্থ, লোভ ও প্রতিপত্তির কথা ভাবতে ভাবতে একসময় অনেক দূরে সরে যেতে হয় এই স্নিগ্ধ প্রেমের আবহ থেকে জাগতিক স্বার্থপরতার দিকে। তবু এ উপলব্ধি কম-বেশি আমাদের জীবনের পরতে পরতে জমে থাকা স্মৃতিগুলির মধ্যে যে সবচেয়ে ‘সুখের স্মৃতি’ হয়েই ধরা দেয়, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
যাকে ভালোবাসা যায় তার উপস্থিতিই তো যথেষ্ট। একজন অন্যজনকে ভালোবাসবে প্রচণ্ড স্বার্থপরের মত, ভালোবাসার মানুষটির জন্য অব্যক্ত ‘মন কেমন করা’ অনুভূতি যেন ঘিরে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত। দ্রোহ ও প্রেমের কবি আমদের নজরুলের গানে যেন ঠিক এমন মুহূর্তটিই ধরা পড়ে-
‘উচাটন মন ঘরে রয় না
প্রিয়া মোর ...’
কখনো কখনো এমন মন উচাটন হলে প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাবার বাসনা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। তখন ভালোবাসার মানুষটিকে মন কাছে পেতে চাইবে একান্ত আপন করে কিন্তু তারপরও বিবাহবন্ধন দ্বারা পরিপক্ক বাঁধন তৈরি করবে না। পৃথিবীর আর দশটি মানুষের মত প্রিয়ার শরীরের বাঁক-ভাজ, চড়াই-উৎরাই প্রিয় কবিতার প্রতি পঙক্তির মত মুখস্ত থাকবে না । তবেই তাকে বলা যাবে প্লেটোনিক প্রেম।
মোটকথা প্লেটোনিক প্রেম তা-ই, যা পরস্পরের প্রতি কখনোই আরোপ করবে না অধিকারবোধ, আশা করবে না প্রতিদান অথচ ভালোবাসার উত্তেজনা থাকবে টানটান। সে টানের তীব্রতায় কখনো কখনো প্রেমিক প্রেমিকাকে জাগতিক দায়িত্ববোধশুন্য এক অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা হতেও দেখা যায়।
উদাহরণ টানতে আবারও প্রেম আর দ্রোহের কবি নজরুলের কাছে যেতে হয়। কবি তার প্রেম কতটা নিঃস্বার্থ এবং তার অনুভুতি কতটা পারমার্থিক তা বোঝাতে গাইলেন আরো একধাপ এগিয়ে-
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’
আসলে ভালোবাসায় যার হৃদয় সরোবর পরিপূর্ণ তার আর কী চাই? গ্যাটে তার কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন ঠিক নজরুলের ভাব ও আবেগের মিশ্র অনুপানে নির্মিত এক অনন্য সাধারণ প্রেমের মদিরা। প্রিয়ার মাদকতাপূর্ণ এক পলক চাহনি আর তার উচ্চারিত একটি মাত্র শব্দের সাথে তুলনা করেছেন পুরো দুনিয়ার জ্ঞানভাণ্ডারকে। অথচ জ্ঞানের কাছে কবি নিজেও ছিলেন অবনত! তারপরও গ্যাটে বলেছেন-
‘ওয়ান গ্লান্স, ওয়ান ওয়ার্ড ফ্রম ইউ
গিব্স মোর প্লেজার দ্যান অল দ্য উইসডম অব দিস ওয়ার্ল্ড’
আমি এর অনুবাদ করেছি এভাবে-
‘মূহুর্তে বিলীন সকল বিদ্যা
এই জগতের জ্ঞানের আলোক,
তুমি যদি বল একটি শব্দ
অথবা তাকাও একটি পলক !’
একই অনুভুতির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই জনৈক উর্দু কবির কবিতায়। তার আবেগ আরো বেশি গতিসম্পন্ন, আরো বেশি করুণ! প্রিয়ার প্রেমে আকন্ঠ নিমজ্জিত কবির কণ্ঠ থেকে নিসৃত হচ্ছে একাকিত্বের পদাবলী-
‘ইস্ তানহাইমে মুঝে রাহত দেতি হ্যায় হাওয়া
উসনে তেরি জিসমে চুমকর আয়ি হ্যায়’
যার অর্থ হলো-
এই একাকীত্বের মাঝেও আমি একটু শান্তি পাচ্ছি
বাতাসের কাছ থেকে, কারণ;
সে যে তোমাকে ছুঁয়েই এসেছে!’
সত্যিই প্রিয় মানুষের কথা, তার কণ্ঠস্বর, মুখাবয়ব, ঘ্রাণ, স্পর্শের অনুভূতি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় তাকে আমি ‘ভালোবাসি!’ শত ব্যস্ততা আর নাগরিক জীবনের নানা ঝামেলার পরও একটু অবসর পেলেই এসব অনুসঙ্গ যেন আমাদের বন্দী স্মৃতির বাক্স থেকে থলের বিড়ালের মত সুরসুর করে বেরিয়ে পড়ে চুপিসারে। মুখে না বললেও মন ঠিক মেহেদী হাসানের গাওয়া গানের ইন্দ্রজালে আটকে যায়। হঠাৎ সবার অলক্ষ্যেই গুনগুন করি আমরা -
‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়
পারি না বোঝাতে মনে
কি যে করি হায়!’
একটু পরনো অথচ আধুনিক বাংলা গানের কথাও মিলে যায় হুবহু-
‘মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে
না জানিয়ে এসে
কাউকে না পেয়ে গেছে কি ঘুরে ’
এখানে শরীরী প্রেমের জায়গা কোথায়? ভিন্ন মানে না খোঁজ করলে মিষ্টি গন্ধটিই তো যথেষ্ট। তাকে ঘিরেই তো তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন আবহ যা এক ধরনের অস্পৃশ্য মোহের মত যা অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্টে নিজেকে আকৃষ্ট করে রাখে। প্রিয়ার রেখে যাওয়া ঘ্রাণে নিজেকে সর্বদা করে রাখে ঘ্রাণময়!
তার অনুপস্থিতিতে তার প্রেমিকা এসে ঘুরে গেছে তারই ঘরে। প্রেমিকার দেখা না পেলেও প্রেমিক ঘ্রাণ শুকেই বুঝে নিয়েছে যে সে এসেছিল। তার মনের মানুষের দেখা না পাক তবু তার শরীরের সুবাসটাতো ছড়িয়ে গেছে সারা ঘরময়। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মত এই ঘ্রাণটুকুকেই সে বারবার মনে করে। যেন প্রেয়সীর শরীরের ঘ্রাণ তার অলক্ষ্যেই নিজের শরীরে লেগে আছে। এটুকুই বা কম কিসে? আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনেও এমন স্মৃতি আজো অক্ষত। অনেকটা ঠিক ধুলোজমা বালকবেলার পাঠ্য বইয়ের মত। একই সাথে মূল্যহীন এবং মূল্যবান। একইভাবে প্রিয় মানুষটির স্মৃতি একই সাথে তুচ্ছ এবং মহা মূল্যবান! যারা প্রেম বলতে শুধুই শরীরকে ভাবেন, তাদের কাছে এমন প্রেম তুচ্ছ বই কিছু নয়। কিন্তু প্রেমে যাদের আস্থা, যারা শরীরিক সম্পর্কের বাইরেও এই অনুভুতির স্বাদ নিতে চায়, তাদের কাছে এটি মহামূল্যবান।
যাকে ভালোবাসা যায় তার স্মৃতিকে সযত্নে রক্ষিত করা যায় হৃদয়ের গহীন ভেতরে। স্পর্শ না করেও তাকে ছোয়াঁ যায় অলৌকিক উপায়ে। অনেক লোকের মাঝেও তার দিকে ব্যক্তিগত চোখে তাকানো যায়, বিনিময় করা যায় অব্যক্ত সব কথামালা। মনে মনে আলতো স্পর্শ করা যায় তার কোমল হাতের আঙুল, কল্পলোকের মাঝে আদর করা যায় তার চিবুক ছুঁয়ে। চোখে চোখ মিলে যাওয়ার যে বিদ্যুৎস্পর্শ, ক্ষণকাল দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে যে নিবিড়তর আলিঙ্গন, সে কি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিতে পারে কখনো? যদি তাই হতো তবে; প্রেম মানেই বোঝাতো শরীর, দেহের সাথে দেহের মিলন। আর কাছে পেলেই নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো কোনও বিপত্তি ছাড়াই। এবং তাহলে আত্মা বা হৃদয় নামের বস্তুটিকে কবেই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হতো! অথচ, যুগে যুগে এমনকি এই মোবাইল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট আর অনলাইনের যুগেও অদৃশ্য এবং অধরা এক বস্তু বা বিষয়কে ধরার জন্য, চেনার জন্য, কত অভিযানই না চলছে। তাকে ধরা যাবে না বা তার দেখা পাওয়া যাবে না জেনেও সবাই তার পেছনে ছুটছে। যেন যে কোনও মূল্যে ধরতে পারলেই হলো একবার। সাধক লালন তার অধরা প্রেমিক আত্মার খোঁজ করতে করতে অবশেষে তাই গেয়েছেন-
‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি ক্যামনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম পাখির পায়’
খোঁজ শেষে লালন বলেছেন-
‘বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...
আবার বলেছেন-
‘সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ-যোজন ফাঁক রে...
কী ভয়ঙ্কর কথা দেখুন। এখানে প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে মিলিত হবার কথা নিজেই ব্যক্ত করছেন অথচ আবার বলছেন- তারা এক স্থানেই ছিলেন কিন্তু, দু’জনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব ছিলো যা তারা ভেদ করতে পারেননি!
সাধক লালনের এই প্রেমও তো কোনও লৌকিকতার সীমা দ্বারা বেষ্টিত নয়। তবে তা অবশ্যই অলৌকিক বা অশারীরিক। সুতরাং ঈশ্বর প্রেমের সংজ্ঞার ছাঁচে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্লেটোনিক প্রেমেরই এক ভিন্ন রূপ যা আমরা অন্য আরো অনেক সাধু পুরুষের সাধনায় দেখতে পাই।
অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য সেই অধরা মহান স্রষ্টার সাথে মিলিত হবার বাসনায়, তাঁর সান্নিধ্য লাভের লক্ষ্যে অলৌকিক পরমকে খুঁজতে গিয়ে মনসুর আল হাল্লাজ তো বলেই ফেললেন ‘আনাল হক’ বা ‘আমিই সত্য!’ সেই সত্যের ভেতরে প্রকৃতপক্ষেই কোনও ধ্রুবসত্য লুকায়িত ছিলো কি না- তা অন্য কেউ আর খোঁজ করতে গেলেন না কেন? কারণ সে সত্য আবিষ্কার করতে হলে নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দেবার ভয় রয়েছে, রয়েছে লৌকিকতার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে যাবার চরম ভয়!
আমরা যাকে প্লেটোনিক প্রেমের অভিধায় আখ্যাায়িত করছি এই লৌকিক মানুষি প্রেমের ভিত্তিমূলেও রয়েছে ঠিক এমন প্রবল ভয়। সামাজিকভাবে অপমানিত হবার ভয়, পরিবার থেকে অবরোধ-প্রতিরোধের ভয়, সর্বোপরি নিজের জীবনে চরম হতাশা বা দুর্দশা নেমে আশার ভয়। এসব জেনে কেউ কি এমন সর্বনাশা প্রেমে হাবুডুবু খেতে চাইবে? সর্বোপরি শুধুমাত্র হাবুডুবু নয়, রীতিমত অকুল পাথারে ডুবে মরার ভয় যেখানে অহরহ বিদ্যমান! এমন ভয়কে জয় করার দুঃসাহস খুব কম লোকই দেখাবে, এটিই স্বাভাবিক।
এসব ব্যতীতও প্লেটোনিক প্রেম নিয়ে অনেকের মনে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। এই অবকাশে তা কিছুটা দূর করা যেতে পারে।
কোনও প্রেম গার্হস্থ্য সীমার ভেতরে এসে পৌঁছায়নি বলেই কিন্তু তাকে নিষ্কাম প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেম বলা যাবে না। মনের মানুষকে সমাজের অনুশাসনের বাঁধা অতিক্রম করে কাছে না পাওয়ার ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে থাকে। না পাওয়ার এই ঘটনা অনেককে ‘দেবদাস’ করে তোলে আবার কেউ বা অতি কষ্টে ভুলে যেতে সক্ষম হন। কেউ আবার তার স্মৃতিকে সযতেœ তুলে রাখেন হৃদয়ের মণিকোঠায়, দীর্ঘশ্বাসের গোপন ঝাঁপিতে। এখানে দেবদাস ও পার্বতীর প্রেমের কাহিনীকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
জীবনের এক পর্যায়ে পার্বতী বিহনে দেবদাসের জীবনে সর্বনাশের ধস নেমেছিল। কিন্তু এর পেছনে কতটা প্রেম হারানোর দুঃখ এবং কতটাই বা পরাজয়ের জ্বালা ছিল কে তার সঠিক হিসেব দেবে? অন্যদিকে যে দেবদাসের জন্য পার্বতীর বুকের পরম গভীরে নিভৃতে প্রেমের কুসুম লুকানো ছিল, সেই উড়নচণ্ডী স্বভাবের দেবদাসের ঘরনী হলে পারু কতখানি সুখী হতো তা নিয়েও রীতিমত সংশয় থাকতে পারে। তাই দেবদাস-পার্বতীর প্রেমও ঠিক অতীন্দ্রিয় প্রেম নয়।
আরো পরিষ্কার করে বললে- কোনওমতে যদি তাদের বিবাহের ক্ষেত্রে মিলে যেতো সমাজের ছাড়পত্র, তাহলেই কিন্তু তাদের ভালোবাসায় এসে পড়তো শরীর প্রসঙ্গ। সর্বোপরি সাধারণ আর দশজনের মতই সাংসারিক টানাপড়েন, ছেলেপুলে, বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত এক দেবদাসকে আমরা পেতাম। বিরহী প্রেমের নায়ক আর অনেকের আদর্শ দেবদাসকে হয়তো আমরা পেতাম না। সুতরাং এখানে দেবদাসও প্রেমের পরিমাপে পুরোপুরি প্লেটোনিক প্রেমিক হতে পারেননি।
অনেকেই এবার প্লেটোনিক প্রেমের সঠিক সংজ্ঞা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। জানতে চাইবেন তা হলে এর সংজ্ঞাটি কী?
জবাবে বলা যায়- প্লেটোনিক প্রেম অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় প্রেম বা দেহবিহীন প্রেম বলা যাবে তাকেই, যা পরস্পরের প্রতি কখনই আরোপ করবে না অধিকার বোধ, আশা করবে না প্রতিদান। বিবাহের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা পেতে কখনোই চাইবে না। এমন একটা সম্পর্ককেই মূলত: প্লেটোনিক প্রেমের সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে-
‘আমার প্রেম রবি কিরণ হেন
জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে তোমারে ঘেরে যেন!’
এই জ্যোতির্ময় মুক্তিই প্লেটোনিক প্রেমের সব থেকে বড় অভিধা।
কিন্তু আমাদের দৈনন্দিনতা কখনো কখনো জীবনটাকে খুব উগ্র করে তোলে, ক্লেদাক্ত করে তোলে মাঝে মধ্যেই। তখন আমাদের ভালোমানুষির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত পিশাচটার আকষ্মিক ঘুম ভাঙ্গে। আর ভেতরে জেগে উঠতে থাকে এক সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। ভালোবাসার প্রেয়সিকেও তখন আমরা তীব্র কামজ্বালা মেটানোর নিমিত্তে স্রেফ মন্থনযোগ্য এক শরীরের আদলে দেখতে শুরু করি। তখন নরম কমনীয় লোভের অতীত প্রেমও এই মহাক্ষুধার আঁচে পুড়ে অংগার হয়ে ওঠে। কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর সেই প্রেম শুধুই শরীর চায়, অধিকার পাওয়ার নেশায় উন্মত্ত হয় এবং তরল সুখ আর প্রমোদে মেতে উঠতে মরিয়া হয়ে পরে। তখন প্রেমের ভাষ্য হয়ে উঠে-
‘আমি তারে ভালোবাসি অস্থিমজ্জাসহ
আমিও রমনীর রূপে
আমি ওই মাংস স্তুপে
কামনায় কামনীয় কেলি কালীদাহ।’
কামনার এই নাগপাশ দিয়েই সে তখন ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁধতে চায়। হাজারো বিধি নিষেধের জালে আবদ্ধ রেখে নিজে তার সুখ পেতে চায়।
তবে, তার মানে যদিও এই নয় যে, শুধুমাত্র যে সম্পর্ককে শরীরি প্রাপ্তির সীমায় পাওয়া যাবে না তাকেই নিষ্কাম প্রেম বলতে হবে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ যে সম্পর্ককে কালো ছাযায় আচ্ছন্ন করে না, স্পর্শের নাগালে পাওয়ার কোনও আকুলতাই যে সম্পর্ককে ব্যাকুল করে তোলে না, কামগন্ধহীন সে প্রেমের ভাষ্য হলো-
‘আমি রূপে তোমায় ভুলাবো না
ভালোবাসায় ভোলাবো,
হাত দিয়ে দ্বার খুলবো নাকো
গান দিয়ে দ্বার খোলাবো।’
ভালোবাসার এমন প্রলেপ পাবার জন্য শরীর তেমনটা দরকারী নয়, দরকারী নয় নিবিড় সান্নিধ্যও। কবির ভাষায়-
‘সারা পৃথিবী আমায় ভুল বুঝলেও
অপরাধি মনে করলেও
যার হৃদয়ে আমি চির মহিমান্বিত হয়ে থাকবো
শুধু তাকে মনে করলেই সব দুঃখ বেদনা উধাও
হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠের রক্তপাত মুহূর্তেই বন্ধ!’
বহুকাল ধরেই নানা উদাহরণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যা দ্বারা প্লেটোনিক প্রেমকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর পক্ষে বা বিপক্ষেও রয়েছে অনেক যৌক্তিক ব্যাখ্যা। থেমে নেই আলোচনা, গবেষণা, অনুসরণ-অনুকরন আর বিতর্কের ঝড়। রুমাল বা পত্র বিনিময়ের যুগ পার হয়ে অনলাইন, মোবাইল, ইন্টারনেটের অত্যাধুনিক এ যুগের প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যেও রয়েছে প্লেটোনিক প্রেমকে জানার প্রবল আগ্রহ। আবার কেউ কেউ এমনও আছেন যে আলোচনার প্রারম্ভেই বাতিল করে দেবেন অশারীরিক বা অতীন্দ্রিয় এই ভালোবাসাকে।
সবশেষে, পাঠকের অনুমতি নিয়ে, জগজিৎ সিংয়ের মদিরামাখা কণ্ঠে গীত কবি শহীদ কবিরের লেখা এ শেরটি দিয়ে শেষ করতে চাই
‘বে সাবাব বাত বারহানি কি জরুরত কিয়া হ্যায়
হাম খাফা কাবথে মানানে কি জরুরত কিয়া হ্যায়...
দিলসে মিলনেকি, তামান্নাহে নেহি জব দিলমে
হাতসে হাত মিলানেকি জরুরত কিয়া হ্যায়!
রঙ্গ আঁখোকে লিয়ে বুহে দামারোকে লিয়ে
ফুলোকো হাত লাগানেকি জরুরত কিয়া হ্যায়!’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
0 comments:
Post a Comment