এই ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কতজন প্রতিবছর বিদেশে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা, বেসরকারি সংস্থা শিসুক, ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্র্যান্টস অ্যালায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থার দাবি, এই সংখ্যা এক লাখ বা এর বেশিও হতে পারে।
অবৈধ এই অভিবাসনের ফলে বাংলাদেশের বৈধ শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈধ কর্মীরা নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অবৈধভাবে থাকার কারণে এসব বাংলাদেশি জেল-জুলুমেরও শিকার হচ্ছেন। তাঁরা খরচের টাকাও তুলতে পারেন না। বৈধভাবে দেশে টাকাও পাঠাতে পারেন না। তাই ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্নও তাঁদের পূরণ হয় না।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আন্তর্জাতিক মানব পাচারবিষয়ক যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তাতে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সারির পর্যবেক্ষণ তালিকায় (ওয়াচলিস্ট ২) রাখা হয়। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ না হলে বাংলাদেশ তৃতীয় সারিতে (সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ টায়ার-৩) নেমে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা আছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, এ তালিকায় গেলে একটি দেশ থেকে বৈধভাবে কেউ শ্রমিক নিতে চায় না। তাই যেকোনো মূল্যে এই তৎপরতা বন্ধ করা উচিত।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কাজের জন্য বিদেশগামীদের সচেতন করতে আজ ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘নিরাপদ অভিবাসন অর্থনীতির উন্নয়ন’। তিনি বলেন, এভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মানব পাচার আইনও করেছে সরকার।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘বছরে যে এক লাখ লোকের মতো অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন, এর সঙ্গে মূলত ট্রাভেল এজেন্সি ও দালালেরা জড়িত। বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশ এসব জানে। বারবার বলার পরও সরকার এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারছে না। ফলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
অবৈধভাবে বিদেশে লোক পাঠানো বন্ধে প্রবাসীকল্যাণ, পররাষ্ট্র, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), পুলিশের বিশেষ শাখাসহ (এসবি) বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে গত বছর একটি টাস্কফোর্স করেছে সরকার।
টাস্কফোর্সের প্রধান প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় আমরা বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজনদের নামিয়ে এনেছি। তবে আমরা যাঁরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাচার বন্ধে কাজ করি, তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।’
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কত লোক অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছেন, জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের প্রধান বলেন, ‘অবৈধভাবে কত লোক যাচ্ছেন এবং ধরা পড়ে ফিরে আসছেন, সেই হিসাব রাখা খুব জরুরি। কিন্তু আমাদের কাছে সেই হিসাব নেই।’
অভিবাসনের নামে পাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা শিসুকের নির্বাহী পরিচালক শাকিউল মিল্লাত বলেন, ‘আমরা মনে করি, প্রতিবছর বৈধভাবে যত লোক যাচ্ছেন, প্রায় সমানসংখ্যক লোক অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা দু-তিন লাখও হতে পারে। এর মধ্যে ওমরাহর নামে সৌদি আরব, ধর্মীয় স্থান দেখা ও জিয়ারতের নামে ইরাকে যাওয়ার কথা এখন গ্রামেগঞ্জেও শোনা যায়। এর বাইরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার অনেক দেশে অবৈধভাবে লোক পাঠানো হচ্ছে। এঁদের অনেকেই প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না।’
ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্র্যান্টস অ্যালায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জাতীয় সমন্বয়ক আনিসুর রহমান খানও মনে করেন, বছরে অন্তত এক লাখ লোক অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছেন। তাঁর দাবি, এর সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সি বা দালালেরা জড়িত থাকলেও শিকড়ে খুঁজলে দেখা যাবে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে এর যোগসাজশ আছে। কারণ, যাঁরা রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, তাঁদেরই আবার নামে-বেনামে ট্রাভেল এজেন্সিও আছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, সৌদি আরব, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবংয় রুমানিয়া, ইতালি, গ্রিসসহ ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, লিবিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে লোক পাঠাচ্ছে দালালেরা। তাদের হাতে প্রতারিত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের কারাগারে সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি আটক আছেন।
ট্রাভেল এজেন্সি বা দালালেরা প্রতারণা করলেও সে ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কোনো অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবছর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গড়ে এক হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। ২০০৮ সালে এমন অভিযোগ জমা পড়েছিল এক হাজার ১০টি, ২০০৯ সালে এক হাজার পাঁচটি, ২০১০ সালে প্রায় এক হাজার ১০০ এবং এ বছর এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে অবৈধ ও প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও পাচারের ঘটনার বিচার করতে প্রয়োজনে বিশেষ আদালত করার কথা বলা হয়। এর মধ্যে সরকার মানব পাচার আইন করেছে। আর কোনো সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, অবৈধ অভিবাসন সমস্যাটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করছে তাঁর সরকার।
0 comments:
Post a Comment