স্রেফ সাদামাটা একটি ছবিই হয়ে উঠতে পারে আইকনিক। আর এমনটিই ঘটেছে চাক ও’রিয়ার-এর বেলায়। যুক্তরাষ্ট্রের নাপা ভ্যালির এক রোদ্রজ্বল নৈসর্গিক দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন তিনি। সম্ভবত উইন্ডোজ এক্সপির কল্যাণে তার সেই ছবিটিই পিসি স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি দেখা ছবি। কিন্তু কী সেই ছবির পেছনের ইতিহাস?
সে সময় সদ্যই প্রেমে পড়েছিলেন চাক ও’রিয়ার। বয়সও বেশি নয়, সদ্যই ৬০ বছর পেরিয়েছেন তিনি। নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে দেখা করতে যাচ্ছিলেন নতুন বান্ধবীর সঙ্গে। আর জাত ফটোগ্রাফার হলে যা হয়, সঙ্গে ছিলো তার প্রিয় ক্যামেরাটিও। চারপাশে ঝলমলে রোদ। রাস্তায় গাড়ি ছুটছে আর চোখ মেলে তিনি রাস্তার দু পাশে চেয়ে দেখলেন। চারপাশে আঙ্গুর বাগান। রাস্তা ছেড়ে সামান্য উঁচু টিলা। সেখানে বেড়ে উঠেছে সারি সারি আঙ্গুরের চারা। জানুয়ারি মাস, সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে নাপা ভ্যালি। আলো এসে পড়েছে তার উপর। গাড়ি থামালেন ও’রিয়ার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন। তারপর ক্যামেরা ধরে তুলে ফেললেন কিছু ছবি। সে ছবিগুলোর একটিই বেছে নিলেন মাইক্রোসফটের কর্তব্যক্তিরা। হয়ে উঠলো উইন্ডোজ এক্সপির ওয়ালপেপার।
অনেক ফটোগ্রাফারই তো প্রকৃতির ছবি তোলেন। এবং অনেকেই ক্যালিফোর্নিয়ার ঐ এলাকাটির ছবি তুলেছেন। কিন্তু ভাগ্য ভালো বলতে হবে ও’রিয়ার-এর। কারণ অসাধারণ ছবি হতে হলে যে আলো প্রয়োজন, তিনি তা পেয়েছিলেন সে মুহুর্তে।
ফটোগ্রাফারদের কাছে আলোর বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘পারফেক্ট লাইট’ বলতে যা বোঝায় সেটিই খোঁজেন তারা। কিন্তু সেই অসাধারণ আলো সবসময় পাওয়া সম্ভব হয় না। ও’রিয়ার সম্ভবত ভাগ্যবানদের একজন যিনি সে মুহুর্তে আলোটা ধরতে পেরেছিলেন।
আবার অনেক ফটোগ্রাফারই ক্যালিফোর্নিয়ার এমন দৃশ্যকে সাদামাটা মনে করে ছবি তোলার প্রয়োজন বোধ করতেন না। কিন্তু ও’রিয়ার বুঝতে পেরেছিলেন, সম্ভবত তিনি অসাধারণ কিছু পেতে যাচ্ছেন সে মুহুর্তটিতে।
চাক ও’রিয়ার একসময় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি যে সময় ছবিটা তুলেছিলেন সে সময় তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ছবি তুলতেন। বয়সও পেরিয়ে গেছে ৬০-এর কোঠা। নীলাকাশ আর সবুজ ঘাসের দৃশ্যটি তার শিল্পীর চোখ ঠিকই খুঁজে নিয়েছিলো আর কথা বলে উঠেছিলো তার ক্যামেরা। কিন্তু ছবিটি তার নিজস্ব ভালোলাগা থেকে তোলা। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তিনি যে মুহুর্তে ছবিটি তুলছিলেন তখন কি তার মনে একবারও উঁকি দিয়েছিলো যে এ ছবিটিই হতে যাচ্ছে কম্পিউটারের পর্দায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশিবার দেখা ছবি?
যখন কোনো ছবির কথা মাথায় আসে বা যখন কোনো ফটোগ্রাফারের তোলা ছবির কথা বলা হয় তখন সবার আগে মনে ভাসে কম্পিউটারের ডেস্কটপে থাকা একটি ছবি। ও’রিয়ারের বাড়ির পাশেই নাপা ভ্যালির এ ছবিটি সারা বিশ্বে বিলিয়ন বারেরও বেশিবার দেখা হয়েছে। কিন্তু যারা নাপা ভ্যালির মুল ছবিটি দেখেন তারা ক্ষণিকবারের মতো ভেবে পাননা যে, এটিই কি ও’রিয়ারের তোলা আসল ছবিটি? আসলে, নাপা ভ্যালির সঙ্গে ও’রিয়ারের তোলা ছবিটির পার্থক্য ধরতে অনেকেই চমকে ওঠেন।
ও’রিয়ারের তোলা ছবিটিই মাইক্রোসফটের কর্তাব্যক্তিরা তাদের এক্সপি অপারেটিং সিস্টেমের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মাইক্রোসফটের সঙ্গে এ ছবিটি ব্যবহারে চুক্তিও করেছেন তিনি। তবে, আর্থিক অঙ্কে ঠিক এ চুক্তির মুল্য কত সেটি প্রকাশ করেননি কোনো পক্ষই। তবে, গুজবে শোনা যায়, এখন পর্যন্ত বিক্রিত ছবিগুলোর মধ্যে এ ফটো লাইসেন্সের জন্য দ্বিতীয় সব্বোর্চ দাম পেয়েছেন ও’রিয়ার।
ও’রিয়ার তার ছবি তোলার এ ঘটনা বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত নাপা ভ্যালি থেকে সান ফ্রান্সিসকোর একই পথে সপ্তাহে একাধিকবার যাতায়াত করতাম। কিন্তু সময়টা যখন জানুয়ারি তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম ঘাসগুলো দারুণ সবুজ। আর তর সইলো না। স্রেফ গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলেই দিলাম ছুট।’
ও’রিয়ারের বলেন, ‘ছবিগুলো আমি ঝটপট তুলেছিলাম খেয়ালবশত; কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের কাছে দ্রুত পৌঁছাবার তাড়ায় কি ছবি তুলেছিলাম সেদিকে আর খেয়াল ছিলো না।’
ও’রিয়ারের এ গার্লফ্রেন্ডের নাম ডাফনি লারকিন। তারা দুজন এ ছবি তোলার কিছুদিন পরেই বিয়ে করেন।
এদিকে, ছবির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন ও’রিয়ার। কিন্তু একদিন তার এজেন্ট ফোন করে তাকে জানালো যে, মাইক্রোসফট তার আসল ছবিটি চেয়ে বসেছে। তারপরই তিনি বুঝতে পারলেন অনেকটা যেনো লটারি জিতে গেছেন তিনি।
ও’রিয়ার জানিয়েছেন, ‘আমি যখন ছবিটি তুলেছিলাম তখন এ ছবিটিই যে আমার ভবিষ্যত পাল্টে দিতে পারে এমন কোনো ধারণাই ছিলো না। এটিই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ছবি। এটা যদি বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে নিয়ে গিয়ে দেখানো হয় তবে সেও যেমন চিনতে পারবে তেমনি চীনের ব্যস্ত রাস্তায় যদি কাউকে ছবিটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় তবে সেও ছবিটির বিষয়ে বলতে পারবে।’
‘কানসাস সিটি স্টার’-এ ক্যারিয়ার শুরু করা ও’রিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসেও কাজ করেছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ ২৫ বছর পার করার পর তিনি অবসরে যান। নাপা’র ফটোগ্রাফিক ওয়াইনমেকিং নিয়ে এখন কাজ করছেন তিনি।
সারা বিশ্বের এক্সপি ব্যবহারকারীরা তার তোলা ছবি দেখতে পেলেও তিনি তার তোলা ছবিটি নিয়মিত দেখতে পাননা। কেনো? কারণ বিষয়টি তার ভাষায় ‘একটু উইয়ার্ড’! ও’রিয়ার বলেন, আমি আসলে ব্যবহার করি অ্যাপলের ম্যাক কম্পিউটার’।
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম
0 comments:
Post a Comment