দীর্ঘ বন্ধুর পথ আর কার্পাস তুলার মাঠ পেরিয়ে যেতে হয় ভারতের মহারাষ্ট্রের জালকা গ্রামে। এ গ্রামেই বাস করেন ৫৫ বছর বয়সী আলোচিত নারী কালাবতী বান্দুকর। আহামরি কিছু করে তিনি আলোচনায় আসেননি। আলোচনায় এসেছেন দারিদ্র্যের নির্মম পরিহাসের জের ধরে।
কালাবতী বান্দুকরের জীবনের করুণ কাহিনি জানতে ফিরে তাকাতে হবে একটু অতীতে। দারিদ্র্যের কারণে ২০০৫ সালে তাঁর স্বামী আত্মহত্যা করেন। ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে ২০১০ সালে কালাবতীর ছেলে ও শ্বশুর আত্মহত্যা করেন। আর একই কারণে সেপ্টেম্বরে তাঁর মেয়ে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
মহারাষ্ট্রে দারিদ্র্যের নির্মমতা তুলে ধরতে ২০০৮ সালে লোকসভার এক বক্তৃতায় রাহুল গান্ধী কালাবতীর উদাহরণ টেনেছিলেন। কিন্তু সেই রাহুলও তাঁকে ভুলে গেছেন। দিনরাত শ্রম দিয়েও কালাবতীর পরিবারের ঋণের বোঝা কাটেনি।
ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এমন অসংখ্য কালাবতী আছেন। সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড গ্লোবাল জাস্টিস অব নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব লর হিসাব অনুসারে, গত ১৬ বছরে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এলাকায় সর্বোচ্চসংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের অধিকাংশই তুলাচাষি। মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চরম দারিদ্র্যের কারণে ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে মহারাষ্ট্রে প্রায় ২৯ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে বিদর্ভে ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে আট হাজার ৬৫২ জন আত্মহত্যা করেছেন। আর সেখানে চলতি বছর এরই মধ্যে ৬৪৭টি আত্মহত্যার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
কয়েকটি প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ভারতের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কারণে তাঁদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করে রক্ষা পান ঠিকই কিন্তু পরিবারের জীবিত সদস্যার রক্ষা পান না। ঋণের ঘানি তাঁদের ঠিকই টানতে হয়। এ চক্র থেকে তাঁদের রেহাই হয় না।
ভারতের দারিদ্র্য পরিস্থিতির এই বাস্তব চিত্রের বিপরীতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং গ্রুপ সিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারত হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি।
একই সঙ্গে ওই গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০৫০ সালে ভারতের জিডিপি হবে ৮৫ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। একই মানদণ্ডে ৮০ দশমিক ০২ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি নিয়ে চীন দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে।
২০৫০ সালে ভারতের আনুমানিক জনসংখ্যা হবে ১৬৩ কোটি। তখন দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৫৩ হাজার ডলার। এ আয় বর্তমানের ধনী দেশ সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ের মানুষের মাথাপিছু আয়ের মতো। কিন্তু খাতা-কলমে তা হলেও বাস্তবে এটা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে বিদর্ভসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সীমাহীন দারিদ্র্য।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের কারণে ভারতে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন। দেশটির দারিদ্র্য পরিস্থিতির এ প্রেক্ষাপটে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানের খবর বিশ্লেষকদের কাছে অলীক কল্পনা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক বটে।
0 comments:
Post a Comment