এমন অবিশ্বাস্য এক কাজকেই সম্ভব করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পাঁচ তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী। যন্ত্রকৌশল বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া এই মেধাবীরা হলেন নাহিয়ান বিন হোসেন, তাউসিফ আহমেদ, ইয়াসিন আলী, বখতিয়ার উদ্দিন ও শরফ শাহরুল হক। তাঁরা ‘নাইপটা-৮’ নামের এক গাড়ির মডেল উদ্ভাবন করেছেন।
এই উদ্ভাবন তাঁদের জন্য বয়ে এনেছে গৌরব ও স্বীকৃতি। বুয়েট ও জাইকার আয়োজিত ‘ইকোরান বাংলাদেশ ২০১৩’ শীর্ষক এক প্রতিযোগিতায় নাইপটা-৮ অর্জন করেছে চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। মাস দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ওই প্রতিযোগিতায় রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, এমআইএসটি ও আইইউটি থেকে অংশগ্রহণ করা ১৪টি দলের মধ্যে বুয়েটের এই দল অর্জন করে সেরা পুরস্কার। রানারআপ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে চুয়েট। আর প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে রুয়েট।
স্বপ্নবান এই পাঁচ তরুণ খুব সংগত কারণেই এখন ভীষণ আশাবাদী। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হবে বাংলাদেশের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অচিরেই হয়তো এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি করবে এমন সব গাড়ি। কেননা, নাহিয়ানেরা মনে করছেন, তাঁদের উদ্ভাবিত এই গাড়ির রয়েছে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যা গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই আকৃষ্ট করবে। কী সেসব বৈশিষ্ট শোনা যাক তাঁদের মুখেই।
‘প্রথমত, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এখন আমরা কমবেশি সবাই জানি যে জ্বালানি বেশি খরচ হওয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের এই গাড়িতে যেহেতু কম জ্বালানি ব্যয় হবে, তাই পরিবেশের ক্ষতি হবে কম। পরিবেশবান্ধব এমন গাড়ি তাই জনপ্রিয় হওয়া স্বাভাবিক।’ বলছিলেন নাহিয়ান। তাঁকে সঙ্গ দিতে কথা শুরু করলেন নাহিয়ানের সহপাঠী তাউসিফ, ‘আমাদের এই গাড়ির বডি তৈরি করা হয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের ফাঁপা পাইপ দিয়ে। চেসিস তৈরিতে অ্যালুমিনিয়ামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে গ্যালভানাইজিং মাইল্ড স্টিল। এসব উপাদান আমাদের দেশে স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় বলে এই গাড়ির উৎপাদন খরচ হবে কম। আর ইঞ্জিন হিসেবে যেহেতু ব্যবহার করা হয়েছে মোটরবাইকের ইঞ্জিন, তাই জ্বালানি খরচ হবে কম। কিন্তু ঘণ্টায় অন্যান্য গাড়ির তুলনায় এই গাড়ি পাড়ি দেবে বেশি পথ।’
নিজেদের উদ্ভাবিত গাড়ির গুণাগুণ বর্ণনা করছেন তাঁরা। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। আমাদের মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তাউসিফ আবার বলতে শুরু করেন কীভাবে রাত-দিন একাকার করে তাঁরা এই মডেল দাঁড় করিয়েছেন। ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট—এসব নিত্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা পড়ে ছিলেন ল্যাবরেটরিতে। এক বন্ধু বংশাল গেছেন মডেলের উপাদান সংগ্রহ করতে তো আরেক বন্ধু গেছেন ধোলাইখাল। এক বন্ধু গবেষণাগারে তো আরেক বন্ধু স্যারের কাছে পরামর্শ গ্রহণ করতে। এভাবেই টানা দেড় মাস। ইয়াসিন বলছিলেন, ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার আমাদের ক্লাস থাকে না। তাই এই দুই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমরা ল্যাবে কাজ করতাম।’ ইয়াসিনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বখতিয়ার বললেন, ‘ভুলে গেলি, অনেক দিন রাত ১০টা পর্যন্তও কাজ করেছিলাম।’
না, সেসব দিনের কথা ভোলেননি তাঁরা। ভোলেননি এই প্রকল্পের কাজে সহায়তাকারী তিন শিক্ষকের কথাও। ‘মনন মাহবুব স্যার, এহসান স্যার ও মামুন স্যারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। স্যাররা সর্বাত্মক সাহায্য না করলে আমাদের সফল হওয়া সম্ভব হতো না।’ বলছিলেন শরফ শাহরুল।
এখন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা আশা করেন এই পাঁচ স্বপ্নবান তরুণ। তাঁরা বিশ্বাস করেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশকে আর উচ্চমূল্যে কর দিয়ে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করতে হবে না। দেশেই তৈরি হবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নত মানের গাড়ি। একদিন বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় ছুটে চলবে নাইপটা-৮।
0 comments:
Post a Comment