বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা কিছু কম হয়নি। তবু এই তিনটি বিষয়েরই কোনো কোনো দিক সম্পর্কে আমরা যেসব সুস্পষ্টভাবে ধারণা পেয়েছি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কয়েক বছর আগে কলকাতার দেশ পত্রিকায় একটি লেখা ছাপা হয়েছিল ‘কে বাঙালি? কেন বাঙালি?’—এই শিরোনামে। সে আলোচনায়ও বিষয়টির যুক্তিসংগত ফয়সালা হয়েছিল এমন নয়। এই আলোচনা হয়তো আরও বহুদিন চলবে। চলা প্রয়োজনও। কারণ, ইতিহাসের তথ্যপ্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের মীমাংসা না হলে তা অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমান লেখায় আমরা এই তিনটি বিষয়েরই ইতিহাসনির্ভর এবং যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে পারব, এমন নয়। সে ধরনের মীমাংসার জন্য ঐতিহাসিক, পণ্ডিত ও বিদগ্ধজনদের পারস্পরিক তর্ক-তদন্ত প্রয়োজন হবে এবং সেই ধারাতেই হয়তো একদিন আমরা প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান পাব।
বর্তমান লেখাটিতে আমরা বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সনের একটি সমন্বিত বিকাশধারার অনুসন্ধানে প্রয়াসী হব। এখন অনেকেই বলেন, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস দুই হাজার-আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। এ তথ্যের সবটাই যে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, রাজবংশসমূহের মুদ্রা, প্রাচীন লেখমালা বা শিলালিপির মাধ্যমে আমরা পরিষ্কারভাবে জেনে গেছি, এমন নয়। বাংলার কোনো কোনো প্রাচীন সভ্যতার কোনো কোনো কেন্দ্রস্থানে খননের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, বাংলা একটি প্রাচীন দেশ। আমাদের ইতিহাস এবং সাহিত্যের নানা তথ্য-উপাত্ত-ইঙ্গিতের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসকেও বেশ প্রাচীন বলেই মনে করা যায়।
তবে বাঙালি জাতির বিকাশ স্বাভাবিকভাবেই ওই দুই ইতিহাসের সুস্পষ্ট মীমাংসানির্ভর বলে অনেকটাই অর্বাচীন। আর যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, তাহলে তো তা বহুলাংশে পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্র গঠনের আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রভাবিত—সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমাদের কিংবদন্তিপ্রতিম পণ্ডিত সাবেক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বাঙালি বা বাঙালিত্বের ইতিহাস পাঁচ শ বছরের বেশি নয়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই এই ইতিহাস একটা রূপ নিতে থাকে। রাজ্জাক সাহেবের এই বক্তব্যের পরও ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অস্পষ্ট-সুস্পষ্ট ইঙ্গিতময় যেসব ইশারাসূচকের দিশা পাই, তাতে বাংলা ও বাঙালিত্বের বিকাশকে আরও শতাধিক বছর বা তার থেকেও পিছিয়ে নেওয়া সম্ভব। এর আরও আগে এই সময়কে চিহ্নিত করতে গেলে কিছু কিছু পরোক্ষ এবং কম জোরালো যুক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। অষ্টম শতকে পাল যুগে যে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, তাকে অনেকেই বাঙালির সৃজনপ্রতিভার চমৎকার নিদর্শন বলে মনে করেন।
এ ছাড়া চর্যাপদে সিদ্ধাচার্য ভুসুকের রচনায় আমরা পাই, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভৈলী’। বাংলাদেশে যেসব জনপদ প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছিল, তার একটি অংশের নামও ছিল ‘বঙ্গা’। এসব বিষয় থেকে বাংলা ও বাঙালিত্বের প্রত্নরূপের একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
তবে আমরা ইতিহাসের দিক থেকে এই বিষয়টায় গুরুত্ব দিতে চাই, মধ্যযুগের স্বাধীন বাংলার চতুর্দশ শতকে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্র উপাধিটির ওপর। তিনি নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়ান’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। বাঙালি যদি তখন একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত না করত, তাহলে অমিত শক্তিধর একজন মুসলিম শাসক নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়ান’ বা ‘বাঙালিদের বাদশা’ বলে গৌরব বোধ করতেন না। এ ঘটনাটিকে যদি আমরা জোরালো প্রমাণ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে চতুর্দশ শতকেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে যে পৌঁছেছিল, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না।
সুলতানি আমলে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ প্রমুখও একটি সমন্বিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে যে কাজ করেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওই সময়ে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশের মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি ও ইতিহাসসাধনার উপাদান বাংলায় অনুবাদ করিয়ে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, পরমতসহিষ্ণু বাঙালি জাতি গঠনের পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলেন—এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যেসব আরবীয় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসেন, তাঁরাও এই অঞ্চলে তাঁদের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাননি; বরং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আরবীয় সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনের সহায়তা করেছিলেন—ইতিহাসে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলা যত দিন উত্তর ভারতের রাজকীয় শক্তির অধীনে আসেনি, তখন বাঙালির সংস্কৃতি যেমন গড়ে উঠতে থাকে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি এবং বাঙালি জাতি গঠনের পরোক্ষ প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। কিন্তু ষোড়শ শতকে মোগলদের শাসনামলে মহামতি আকবর যখন বাংলাদেশ দখল করে তাকে গোটা ভারতবর্ষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে সক্ষম হন, তখনই বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্ব বিকাশের ধারায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে শেষ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের নানা ইঙ্গিত থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ষোড়শ শতকের কবি সৈয়দ সুলতান যখন বাংলা ভাষায় তৎকালে প্রচলিত প্রেমোপাখ্যান রচনার নিয়মিত ধারার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের বিষয় সম্পর্কে লিখতে প্রয়াসী হন, তখন গোঁড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা কবিকে ‘মোনাফেক’রূপে চিত্রিত করেন। কবি এ বিষয়ে শব-ই-মিরাজ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন। সেই ভাষ তাহার অমূল্য রতন।’ এতে স্পষ্ট হয়, বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার অভিজাত সম্প্রদায় এবং শাসক শ্রেণীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
কবিকে ‘মোনাফেক’ বলা সত্ত্বেও তিনি দমেননি, বাংলা ভাষায়ই ধর্মচর্চাও করে গেছেন। এ অবস্থা যে পরবর্তী শতাব্দীতে আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবদুল হাকিমের (সপ্তদশ শতক) রচনায়: ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এতে প্রমাণিত হয়, সমাজপতি এবং শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষার চর্চাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে বাঙালি জাতি গঠনে বিশিষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তবে মধ্যযুগের মুসলিম সুলতানি আমলে যে জিনিসটি সম্ভব হয়নি, মোগল আমলে তা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে উত্তর ভারতের প্রভাবে আশরাফ-আতরাফ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইরান এবং উত্তর ভারতের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রভাবে বাঙালি অভিজাত মুসলমানদের (আশরাফ) জন্য হিন্দুস্থানি এবং উর্দু ভাষাকে গ্রহণযোগ্য করা হয়। আর আতরাফ অর্থাৎ নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের জন্য বাংলাকে নির্ধারণ করা হয়। এতে শত শত বছর ধরে বাংলা ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক ধারার যে বিকাশ সাধিত হচ্ছিল, তা বাধাগ্রস্ত হয়।
ওপরে আমরা বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের যে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছি, তাতে কোনো মোগল সম্রাট বা উত্তর ভারতের সংস্কৃতি-প্রভাবিত শাসক সমন্বয়বাদী বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন—এমন মনে করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তাঁরা যখন গোটা বাংলাকে মোগল শাসনে এনেছিলেন, তখন সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যদি অপরিহার্য হয়ে থাকে, তাহলেই হয়তো তাঁরা বাংলা সন প্রবর্তন করে থাকতে পারেন। এসব বিষয়ের আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অনুপুঙ্খ তথ্যপ্রমাণ নেই। কোনো কোনো বিখ্যাত ঐতিহাসিক মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন, এমনটি বলে থাকেন। কিন্তু আকবরের আইন-ই-আকবরীতে আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন—এমন কথা লেখা নেই। তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে যেসব সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা পরিষ্কারভাবে উপর্যুক্ত গ্রন্থে লেখা আছে। তবে তিনি যে সর্বভারতীয় ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন, বাংলা সনের প্রবর্তনে তার প্রভাব থাকা খুবই সম্ভব এবং এ কথাও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আকবর বাংলা সন প্রবর্তন না করলেও কোনো না কোনো মুসলমান বাদশা বা সুলতান যে এ সন প্রবর্তন করেন, তাতে কোনো সন্দেহের কারণ নেই। এমনও হতে পারে যে আকবরের ইলাহী সনকেই উৎস হিসেবে ধরে বাংলা অঞ্চলের কোনো রাজা-বাদশাহ বা সুবেদার বাংলা সন প্রবর্তন করে থাকতে পারেন। বাংলা সনকে ‘সন’ বা ‘সাল’ বলা হয়। ‘সন’ আরবি শব্দ। ‘সাল’ ফার্সি শব্দ। কোনো মুসলমান শাসক এই সন প্রবর্তন না করলে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে বাংলা সনের তারিখ বলা হতো না। ‘তারিখ’ শব্দটিও মুসলমানি শব্দ। অতএব, বাংলা সন কোনো মুসলমান শাসকের এবং মুসলিম আমলেই যে সৃষ্টি, এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।
মোগল সুলতানেরা ইরানের নববর্ষ উৎসব উপলক্ষে দিল্লিতে এবং পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে উৎসবের আয়োজন করতেন। দিল্লিতে নারীদের জন্য এ উপলক্ষে ‘মিনা বাজার’ আয়োজন করা হতো। এই ধারার সঙ্গে বাংলা সনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এ থেকে কিছু অনুপ্রেরণায় হয়তো বাংলা অঞ্চলের কোনো সুবেদার এ অঞ্চলে বাংলা সন প্রবর্তনে উৎসাহিত হয়ে থাকতে পারেন। মুর্শিদ কুলী খান, আলীবর্দ্দী খাঁ প্রমুখ বাঙালির নানা উৎসব অনুষ্ঠান যেমন—বেড়াভাসান, জমিদারদের পুণ্যাহ এবং ব্যবসায়ীদের হালখাতা ইত্যাদিতে যোগ দিতেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরাও বাংলা সন প্রবর্তনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারেন।
ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথদের পরিবারে পাশ্চাত্য নববর্ষের অনুসরণে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ব্যবস্থা করেন। কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারেও এভাবে ধীরে ধীরে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনার খবরাদি পাওয়া যায়।
পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপিত হতো প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই। নববর্ষের আদি অনুষ্ঠান হিসেবে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘আমানি’ উৎসবের কথা বলেছিলেন। এটি ছিল কৃষকদের উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানিঘরে একটি নতুন ঘটে আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন এবং তাতে একটি আমগাছের কচি পাতাযুক্ত ছোট ডাল রেখে দিতেন। পরদিন সকালে সেই পাতাযুক্ত ডাল থেকে ঘরের চারদিকে পানি ছিটিয়ে দিতেন। এতে গোটা ঘরটি পরিশুদ্ধ হলো বলে মনে করা হতো এবং সারা বছরের জন্য মঙ্গল কামনায় এ অনুষ্ঠান করা হতো। কৃষক যখন খেতে হাল দিতে যেতেন, তাঁর শরীরেও ওই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। মনে করা হতো, এতে খেতে বেশি পরিমাণ ফসল ফলবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামীণ মেলাও অনুষ্ঠিত হতো। এই মেলা একদিকে যেমন ছিল নববর্ষের আনন্দ আয়োজনের জন্য, তেমনি সাংবাৎসরিক সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখারও একটি প্রধান উপায়। এ ছাড়া খেলাধুলারও আয়োজন হতো। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, গরুর দৌড়, মোরগের লড়াই, যাত্রা-জারিগান, পাঁচালি, পুঁথিপাঠ, পুতুলনাচ, সার্কাস ইত্যাদি বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল।
বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে মানুষের হাতে নগদ পয়সা না থাকায় বাকিতে কেনাবেচা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ফসল বিক্রির টাকায় নববর্ষের দিনে সারা বছরের বাকি শোধ করতেন গ্রাহক-অনুগ্রাহকেরা। আর মুদি দোকানি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপত্রের মালিকেরা নববর্ষ উপলক্ষে ‘হালখাতা’র আয়োজন করতেন। এতে ধূপ-ধুনো এবং রংবেরঙের কাগজ দিয়ে দোকানপাট সাজানো হতো। দোকানি গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের মিষ্টিমুখে আপ্যায়িত করতেন আর গ্রাহকেরা সারা বছরের বাকির টাকা পরিশোধ করে নতুন খাতা বা হালখাতা খুলতেন। অন্যদিকে জমিদার বাড়িতে প্রজারা নববর্ষে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবে যোগ দিতেন। সেখানেও মিষ্টিমুখ এবং পান-সুপারি দিয়ে প্রজাদের আপ্যায়িত করা হতো। আর প্রজারাও তাঁদের সারা বছরের খাজনা পরিশোধ করতেন। মোটামুটিভাবে এই ছিল গ্রামবাংলার নববর্ষ উৎসবের চালচিত্র।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মুখে পড়ে। তারা একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করে। বাঙালি পণ্ডিতেরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের নেতৃত্বে সম্রাট আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, সেটি বলেই বাঙালির নববর্ষকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সরকার সেই দাবি অগ্রাহ্য করে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’ (১৯৬১) নামক আজকের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। এই সংগঠন ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে নিয়মিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির নানা আঙ্গিকে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে শুরু করে। সেই নববর্ষ উৎসব প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে। এখন সেই অনুষ্ঠান বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলা ও বাঙালিত্বের বিকাশে এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনাকে শাণিত করার ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষ উৎসব তুলনারহিত।
নতুন আঙ্গিকে বাঙালির এই মহান জাতীয় উৎসবটি এখন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, গোটা বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একসময় যা ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশের কৃষকের ক্ষুদ্র এবং সীমিত অনুষ্ঠান, তা এখন বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনের বাঙ্ময় প্রকাশের এক অনন্য রূপ যেমন লাভ করেছে; তেমনি তা নানা সামাজিক, অনাসৃষ্টি, ধর্মান্ধতা, স্বৈরশাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের মঙ্গল-শোভাযাত্রায় ব্যবহূত মুখোশ, প্রতীক, কার্টুন ও আবহমান বাংলার নানা ভাবব্যঞ্জনার চিত্রণের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সৌন্দর্যচেতনা, মানবিকবোধ এবং শ্রেয়চেতনার এক অনুপম উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
বর্তমান লেখাটিতে আমরা বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সনের একটি সমন্বিত বিকাশধারার অনুসন্ধানে প্রয়াসী হব। এখন অনেকেই বলেন, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস দুই হাজার-আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। এ তথ্যের সবটাই যে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, রাজবংশসমূহের মুদ্রা, প্রাচীন লেখমালা বা শিলালিপির মাধ্যমে আমরা পরিষ্কারভাবে জেনে গেছি, এমন নয়। বাংলার কোনো কোনো প্রাচীন সভ্যতার কোনো কোনো কেন্দ্রস্থানে খননের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, বাংলা একটি প্রাচীন দেশ। আমাদের ইতিহাস এবং সাহিত্যের নানা তথ্য-উপাত্ত-ইঙ্গিতের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসকেও বেশ প্রাচীন বলেই মনে করা যায়।
তবে বাঙালি জাতির বিকাশ স্বাভাবিকভাবেই ওই দুই ইতিহাসের সুস্পষ্ট মীমাংসানির্ভর বলে অনেকটাই অর্বাচীন। আর যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, তাহলে তো তা বহুলাংশে পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্র গঠনের আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রভাবিত—সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমাদের কিংবদন্তিপ্রতিম পণ্ডিত সাবেক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বাঙালি বা বাঙালিত্বের ইতিহাস পাঁচ শ বছরের বেশি নয়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই এই ইতিহাস একটা রূপ নিতে থাকে। রাজ্জাক সাহেবের এই বক্তব্যের পরও ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অস্পষ্ট-সুস্পষ্ট ইঙ্গিতময় যেসব ইশারাসূচকের দিশা পাই, তাতে বাংলা ও বাঙালিত্বের বিকাশকে আরও শতাধিক বছর বা তার থেকেও পিছিয়ে নেওয়া সম্ভব। এর আরও আগে এই সময়কে চিহ্নিত করতে গেলে কিছু কিছু পরোক্ষ এবং কম জোরালো যুক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। অষ্টম শতকে পাল যুগে যে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, তাকে অনেকেই বাঙালির সৃজনপ্রতিভার চমৎকার নিদর্শন বলে মনে করেন।
এ ছাড়া চর্যাপদে সিদ্ধাচার্য ভুসুকের রচনায় আমরা পাই, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভৈলী’। বাংলাদেশে যেসব জনপদ প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছিল, তার একটি অংশের নামও ছিল ‘বঙ্গা’। এসব বিষয় থেকে বাংলা ও বাঙালিত্বের প্রত্নরূপের একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
তবে আমরা ইতিহাসের দিক থেকে এই বিষয়টায় গুরুত্ব দিতে চাই, মধ্যযুগের স্বাধীন বাংলার চতুর্দশ শতকে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্র উপাধিটির ওপর। তিনি নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়ান’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। বাঙালি যদি তখন একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত না করত, তাহলে অমিত শক্তিধর একজন মুসলিম শাসক নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়ান’ বা ‘বাঙালিদের বাদশা’ বলে গৌরব বোধ করতেন না। এ ঘটনাটিকে যদি আমরা জোরালো প্রমাণ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে চতুর্দশ শতকেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে যে পৌঁছেছিল, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না।
সুলতানি আমলে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ প্রমুখও একটি সমন্বিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে যে কাজ করেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওই সময়ে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশের মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি ও ইতিহাসসাধনার উপাদান বাংলায় অনুবাদ করিয়ে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, পরমতসহিষ্ণু বাঙালি জাতি গঠনের পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলেন—এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যেসব আরবীয় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসেন, তাঁরাও এই অঞ্চলে তাঁদের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাননি; বরং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আরবীয় সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনের সহায়তা করেছিলেন—ইতিহাসে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলা যত দিন উত্তর ভারতের রাজকীয় শক্তির অধীনে আসেনি, তখন বাঙালির সংস্কৃতি যেমন গড়ে উঠতে থাকে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি এবং বাঙালি জাতি গঠনের পরোক্ষ প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। কিন্তু ষোড়শ শতকে মোগলদের শাসনামলে মহামতি আকবর যখন বাংলাদেশ দখল করে তাকে গোটা ভারতবর্ষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে সক্ষম হন, তখনই বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্ব বিকাশের ধারায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে শেষ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের নানা ইঙ্গিত থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ষোড়শ শতকের কবি সৈয়দ সুলতান যখন বাংলা ভাষায় তৎকালে প্রচলিত প্রেমোপাখ্যান রচনার নিয়মিত ধারার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের বিষয় সম্পর্কে লিখতে প্রয়াসী হন, তখন গোঁড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা কবিকে ‘মোনাফেক’রূপে চিত্রিত করেন। কবি এ বিষয়ে শব-ই-মিরাজ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন। সেই ভাষ তাহার অমূল্য রতন।’ এতে স্পষ্ট হয়, বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার অভিজাত সম্প্রদায় এবং শাসক শ্রেণীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
কবিকে ‘মোনাফেক’ বলা সত্ত্বেও তিনি দমেননি, বাংলা ভাষায়ই ধর্মচর্চাও করে গেছেন। এ অবস্থা যে পরবর্তী শতাব্দীতে আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবদুল হাকিমের (সপ্তদশ শতক) রচনায়: ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এতে প্রমাণিত হয়, সমাজপতি এবং শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষার চর্চাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে বাঙালি জাতি গঠনে বিশিষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তবে মধ্যযুগের মুসলিম সুলতানি আমলে যে জিনিসটি সম্ভব হয়নি, মোগল আমলে তা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে উত্তর ভারতের প্রভাবে আশরাফ-আতরাফ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইরান এবং উত্তর ভারতের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রভাবে বাঙালি অভিজাত মুসলমানদের (আশরাফ) জন্য হিন্দুস্থানি এবং উর্দু ভাষাকে গ্রহণযোগ্য করা হয়। আর আতরাফ অর্থাৎ নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের জন্য বাংলাকে নির্ধারণ করা হয়। এতে শত শত বছর ধরে বাংলা ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক ধারার যে বিকাশ সাধিত হচ্ছিল, তা বাধাগ্রস্ত হয়।
ওপরে আমরা বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের যে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছি, তাতে কোনো মোগল সম্রাট বা উত্তর ভারতের সংস্কৃতি-প্রভাবিত শাসক সমন্বয়বাদী বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন—এমন মনে করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তাঁরা যখন গোটা বাংলাকে মোগল শাসনে এনেছিলেন, তখন সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যদি অপরিহার্য হয়ে থাকে, তাহলেই হয়তো তাঁরা বাংলা সন প্রবর্তন করে থাকতে পারেন। এসব বিষয়ের আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অনুপুঙ্খ তথ্যপ্রমাণ নেই। কোনো কোনো বিখ্যাত ঐতিহাসিক মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন, এমনটি বলে থাকেন। কিন্তু আকবরের আইন-ই-আকবরীতে আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন—এমন কথা লেখা নেই। তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে যেসব সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা পরিষ্কারভাবে উপর্যুক্ত গ্রন্থে লেখা আছে। তবে তিনি যে সর্বভারতীয় ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন, বাংলা সনের প্রবর্তনে তার প্রভাব থাকা খুবই সম্ভব এবং এ কথাও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আকবর বাংলা সন প্রবর্তন না করলেও কোনো না কোনো মুসলমান বাদশা বা সুলতান যে এ সন প্রবর্তন করেন, তাতে কোনো সন্দেহের কারণ নেই। এমনও হতে পারে যে আকবরের ইলাহী সনকেই উৎস হিসেবে ধরে বাংলা অঞ্চলের কোনো রাজা-বাদশাহ বা সুবেদার বাংলা সন প্রবর্তন করে থাকতে পারেন। বাংলা সনকে ‘সন’ বা ‘সাল’ বলা হয়। ‘সন’ আরবি শব্দ। ‘সাল’ ফার্সি শব্দ। কোনো মুসলমান শাসক এই সন প্রবর্তন না করলে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে বাংলা সনের তারিখ বলা হতো না। ‘তারিখ’ শব্দটিও মুসলমানি শব্দ। অতএব, বাংলা সন কোনো মুসলমান শাসকের এবং মুসলিম আমলেই যে সৃষ্টি, এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।
মোগল সুলতানেরা ইরানের নববর্ষ উৎসব উপলক্ষে দিল্লিতে এবং পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে উৎসবের আয়োজন করতেন। দিল্লিতে নারীদের জন্য এ উপলক্ষে ‘মিনা বাজার’ আয়োজন করা হতো। এই ধারার সঙ্গে বাংলা সনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এ থেকে কিছু অনুপ্রেরণায় হয়তো বাংলা অঞ্চলের কোনো সুবেদার এ অঞ্চলে বাংলা সন প্রবর্তনে উৎসাহিত হয়ে থাকতে পারেন। মুর্শিদ কুলী খান, আলীবর্দ্দী খাঁ প্রমুখ বাঙালির নানা উৎসব অনুষ্ঠান যেমন—বেড়াভাসান, জমিদারদের পুণ্যাহ এবং ব্যবসায়ীদের হালখাতা ইত্যাদিতে যোগ দিতেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরাও বাংলা সন প্রবর্তনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারেন।
ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথদের পরিবারে পাশ্চাত্য নববর্ষের অনুসরণে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ব্যবস্থা করেন। কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারেও এভাবে ধীরে ধীরে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনার খবরাদি পাওয়া যায়।
পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপিত হতো প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই। নববর্ষের আদি অনুষ্ঠান হিসেবে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘আমানি’ উৎসবের কথা বলেছিলেন। এটি ছিল কৃষকদের উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানিঘরে একটি নতুন ঘটে আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন এবং তাতে একটি আমগাছের কচি পাতাযুক্ত ছোট ডাল রেখে দিতেন। পরদিন সকালে সেই পাতাযুক্ত ডাল থেকে ঘরের চারদিকে পানি ছিটিয়ে দিতেন। এতে গোটা ঘরটি পরিশুদ্ধ হলো বলে মনে করা হতো এবং সারা বছরের জন্য মঙ্গল কামনায় এ অনুষ্ঠান করা হতো। কৃষক যখন খেতে হাল দিতে যেতেন, তাঁর শরীরেও ওই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। মনে করা হতো, এতে খেতে বেশি পরিমাণ ফসল ফলবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামীণ মেলাও অনুষ্ঠিত হতো। এই মেলা একদিকে যেমন ছিল নববর্ষের আনন্দ আয়োজনের জন্য, তেমনি সাংবাৎসরিক সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখারও একটি প্রধান উপায়। এ ছাড়া খেলাধুলারও আয়োজন হতো। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, গরুর দৌড়, মোরগের লড়াই, যাত্রা-জারিগান, পাঁচালি, পুঁথিপাঠ, পুতুলনাচ, সার্কাস ইত্যাদি বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল।
বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে মানুষের হাতে নগদ পয়সা না থাকায় বাকিতে কেনাবেচা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ফসল বিক্রির টাকায় নববর্ষের দিনে সারা বছরের বাকি শোধ করতেন গ্রাহক-অনুগ্রাহকেরা। আর মুদি দোকানি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপত্রের মালিকেরা নববর্ষ উপলক্ষে ‘হালখাতা’র আয়োজন করতেন। এতে ধূপ-ধুনো এবং রংবেরঙের কাগজ দিয়ে দোকানপাট সাজানো হতো। দোকানি গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের মিষ্টিমুখে আপ্যায়িত করতেন আর গ্রাহকেরা সারা বছরের বাকির টাকা পরিশোধ করে নতুন খাতা বা হালখাতা খুলতেন। অন্যদিকে জমিদার বাড়িতে প্রজারা নববর্ষে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবে যোগ দিতেন। সেখানেও মিষ্টিমুখ এবং পান-সুপারি দিয়ে প্রজাদের আপ্যায়িত করা হতো। আর প্রজারাও তাঁদের সারা বছরের খাজনা পরিশোধ করতেন। মোটামুটিভাবে এই ছিল গ্রামবাংলার নববর্ষ উৎসবের চালচিত্র।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মুখে পড়ে। তারা একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করে। বাঙালি পণ্ডিতেরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের নেতৃত্বে সম্রাট আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, সেটি বলেই বাঙালির নববর্ষকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সরকার সেই দাবি অগ্রাহ্য করে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’ (১৯৬১) নামক আজকের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। এই সংগঠন ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে নিয়মিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির নানা আঙ্গিকে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে শুরু করে। সেই নববর্ষ উৎসব প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে। এখন সেই অনুষ্ঠান বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলা ও বাঙালিত্বের বিকাশে এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনাকে শাণিত করার ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষ উৎসব তুলনারহিত।
নতুন আঙ্গিকে বাঙালির এই মহান জাতীয় উৎসবটি এখন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, গোটা বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একসময় যা ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশের কৃষকের ক্ষুদ্র এবং সীমিত অনুষ্ঠান, তা এখন বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনের বাঙ্ময় প্রকাশের এক অনন্য রূপ যেমন লাভ করেছে; তেমনি তা নানা সামাজিক, অনাসৃষ্টি, ধর্মান্ধতা, স্বৈরশাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের মঙ্গল-শোভাযাত্রায় ব্যবহূত মুখোশ, প্রতীক, কার্টুন ও আবহমান বাংলার নানা ভাবব্যঞ্জনার চিত্রণের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সৌন্দর্যচেতনা, মানবিকবোধ এবং শ্রেয়চেতনার এক অনুপম উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
শামসুজ্জামান খান prothom-alo
0 comments:
Post a Comment