বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন লালন। ছিলেন সাধক গায়ক সুরকার কবি। ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধ এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর সমকালীন সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত, সংস্কার, কুসংস্কার, পাপ-পুণ্যের ধারণা এমনকি ব্যক্তিমানুষের কর্তব্যবোধ ও ক্রিয়ার ক্ষেত্রে একই সঙ্গে প্রশ্ন ও উত্তর করার অসাধারণ একটি সহজ ভঙ্গিমার কাঠামোগত রূপ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর গানে। লালনের সমকালীন সমাজ কেমন ছিল? ইতিহাসবিদদের মতে, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরবর্তীকালে, এক ছিন্নমস্তা রুধির-রঞ্জিত সময়ের গর্ভে তিনি জন্মেছিলেন। পাননি “নিদয়া জননী”র স্নেহ। প্রিয়জনেরা তাকে ডাকত নালন নামে। নাল অর্থ উর্বরা কৃষিজমি। উর্বর মানবজমিনে সুচেতনার আবাদে ব্যস্ত ছিলেন তিনি শতাধিক বৎসরের আয়ুষ্কালে।’ লালনের সমাজে বৈদিক আচার এবং লৌকিক অনাচার, দুটোই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর নিপীড়নের যন্ত্র। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে লালনের দ্বিমুখী সংগ্রাম ছিল আঙ্গিকের দিক থেকে বিনয়ী, বেদনার্ত আর বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তীক্ষ ও কঠোর। আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও। নানা জাতপাতের রক্তসম্পর্কহীন মানুষ মিলে গড়ে উঠেছিল কয়েক হাজার সদস্যের লালন পরিবার। লালন তাঁর শিষ্যদের কী দীক্ষা দিতেন? শুধুই গানের? মনে হয় না। যদি তা-ই হতো, তাহলে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে লালন শিষ্যদের লাঠালাঠি হয়েছিল কোন মন্ত্রবলে? ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল। ঠাকুরদের জমিদারিতেই ছিল তাঁর বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে লালনের সংঘর্ষ ঘটেছিল একবার। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টির প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন। এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে লালন সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন। ভাড়াটে লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কৃষকবন্ধু কাঙালকে চোখের মণির মতো আমৃত্যু রক্ষা করেছেন সশিষ্য লালন। কারণ, লালন এবং তাঁর অনুসারীদের সেদিনের শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও অবস্থান ছিল শোষণের বিরুদ্ধে আর নিপীড়িতের পক্ষে।
গবেষকদের মতানুযায়ী, শতাধিক বছরের আয়ুষ্কালে লালন গান রচনা করেছিলেন প্রায় তিন হাজারের মতো। আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম/ভক্তিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষ/পরমতত্ত্ব, আল্লা/নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ/গৌরতত্ত্ব এবং বিবিধ বিষয় তাঁর গানে উচ্চারিত হয়েছে। লালন গান লিখতেন না। মুখে মুখে পদ রচনা করতেন। সুরারোপ করতেন। যেকোনো গান বা পদের শেষাংশে নিজের নাম উল্লেখ করতেন। সেই অংশকে গীতিকবিরা ‘ভণিতা’ বলে অবহিত করেন। কখনো কখনো ‘ভণিতা’ পদের প্রথমাংশে বা মাঝখানেও ব্যবহূত হতে দেখি আমরা তাঁর গানে। এই যে নানা রকমের বিষয়বৈচিত্র্যে ভরা লালনগীতি, তার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে লালনের সময়ের সমাজ ও জীবনজিজ্ঞাসা। প্রায় দেড় শ বছর আগে (১৮৯১ সাল) তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল, কিন্তু আজও তাঁর গান প্রাসঙ্গিক, সমকালীন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাঁর গান গাওয়া হচ্ছে, শ্রুত হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে স্বদেশে এবং প্রবাসে, গানের ভাষান্তরিত রূপ অন্য ভাষাভাষী মানুষকে জীবনের অনেক মৌলিক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে। এককথায়, লালনের সমকালীন সময়ের চেয়ে তাঁর গানের বাণী ও সুরের বিস্তার এখন অনেক ব্যাপক। গুরুতত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁর অনুসারী বাউলেরা যেমন নাগরিক শ্রোতাদের সামনে গান নিয়ে হাজির হয়েছেন, হচ্ছেন, তেমনি এই সময়ের তরুণকণ্ঠেও গীত হচ্ছেন লালন। সেটা কখনো একক পরিবেশনায়, দলগতভাবে, এমনকি ‘ব্যান্ড’ আঙ্গিকের উপস্থাপনায়ও। দেশের বিভিন্ন স্থানে সোৎসাহে লালন উৎসব আয়োজিত হচ্ছে, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন তাঁর গান, আবিষ্ট হচ্ছেন সুরে। এসব ঘটনার অন্তর্গত শক্তিটি কোথায়? গানে কী এমন সতৃষ্ণ অনুসন্ধিৎসা লালন করেছিলেন, যা আজও আমাদের সচেতন উপলব্ধিতে ঘা দেয়? কেন লালন গুনগুনিয়ে ওঠেন নৈরাশ্যের এপারে, ওপারে যাওয়ার আশাবাদে-আকাঙ্ক্ষায়।
ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যাবে, লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। তাঁর সময়ের যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা, অহম, ব্যক্তিসম্পত্তিজাত মানসিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীলতা ও তার পক্ষের শক্তি ছিল প্রবলতর। সত্য উচ্চারণের কণ্ঠ ছিল দুর্বল। লালনের গান সত্য উচ্চারণে দুর্বলের পক্ষ নিয়েছিল। তাই তো তিনি গেয়েছেন, ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন/ সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি নে মানুষের দরশন...’—এই গান কি এখনো প্রাসঙ্গিক নয়, সমকালীন নয়? সপ্তদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল: সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা, নারীমুক্তি, ইহজাগতিকতা ইত্যাদি। লালন সেই বিপ্লবের বার্তা শুনেছিলেন কি না তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেওয়ার উপায় নেই, কিন্তু তিনি যখন তাঁর গানে বলেন, ‘পরের দ্রব্য পরনারী হরণ করো না/ পারে যেতে পারবে না...’ তখন কি এই আর্তি মানবমুক্তির অন্য অভিলাষ তৈরি করে না? এই প্রশ্নও তো লালন করেছেন যে, পাপ কী পুণ্য কী! বলছেন, ‘পাপ-পুণ্যের কথা আমি কাহারে সুধাই/ এক দেশে যা পাপ গণ্য/ অন্য দেশে পুণ্য তাই...।’ বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের জানায় সেই সত্যভাষণ যে, বস্তুজগতে শাশ্বত বলে কিছু নেই। স্থান-কালনিরপেক্ষ কিছু নয়। একই গানে লালন সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন চারপাশ। সচেতন উপলব্ধিতে বলছেন, ‘তিব্বত নিয়ম অনুসারে/ এক নারী বহু পতি ধরে/ এই দেশেতে হলে পরে/ ব্যভিচারী দণ্ড দেয়...’। তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল যে, তিব্বত নামের দেশে যেটা পাপ নয়, স্বাভাবিক, আমাদের জনপদে তা ব্যভিচার-পাপ! এখন, এই যে আমাদের যাপিত জীবনের বহমান, সময়, সকাল দুপুর রাত, চারপাশের আনন্দ-বেদনার দোলাচলের সবখানেই লালন বিদ্যমান। প্রশ্নে এবং উত্তরে, কর্তব্যে ও বোধে। শুধু মনটা নিয়েই গোলমাল। সেই মন নিয়েও লালন ভেবেছেন। আত্মতত্ত্বের গানে গাইছেন, ‘বল কারে খুঁজিব ক্ষেপা দেশ-বিদেশে/ আপন ঘর খুঁজলে রতন পায় অনায়াসে/ ...আপনাকে আপনি চেনা/ সেই বটে উপাসনা/ লালন কয়, অনেক চেনা/ হয় তার দিশে...।’ মন যদি সহজে না বোঝে তবে বিষম বিপদ; সতর্কবাণী উচ্চারিত হলো তাই, ‘মন তুমি সহজে কি সই হবা/ ভাবার ঘরে মুগুর পলে/ সেই দিনে গা টের পাবা...।’
লালনের সময় থেকে কতদূর এগিয়েছি আমরা? ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, রাজনৈতিক সন্ত্রাস কি এখনো সমাজে বিষবাষ্প ছড়ায় না? আমাদের যাবতীয় অজ্ঞানতা, উপায়হীনতা, ক্রীড়াহীনতা ক্রমেই অন্ধকারকে বিস্তৃত করছে। যে মৌলিক মুখোশের আড়ালে আমরা আমাদের নুয়ে পড়া মুখাবয়ব লুকিয়ে রাখতে চাই, সেই বেদনার সুরেই লালন তাঁর সহজিয়া গানগুলো মালার মতো গেঁথেছেন। অযথাই জটিল ও সমস্যাশ্রিত ভাবনার জগতে ঘাই দিয়ে মমতায় চক্ষুষ্মান করতে গিয়ে কেঁদেছেন এই বলে, ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার...।’ সেসব কারণেই লালন সবারই নিজের। আত্মোপলব্ধির। সচেতনতার। তাঁর গানে দুটি বিশিষ্টতা অন্যদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে। বাণীর ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সময়ের প্রগতিশীল ভাবনাকে অবলম্বন করেছেন আর সুরের আঙ্গিক তৈরি করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বেদনা, কান্না ও হাহাকারকে আঁকড়ে ধরে। লালন তাই এখনো আধুনিক, প্রাসঙ্গিক এবং সমকালীন। সে কারণে তার গান গীত হচ্ছে এখনো। সন্দেহ নেই, এর বিস্তার হবে আরও। যদি আমরা তাঁর গানকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতিয়ার করতে পারি। কারণ, লালন তো তা-ই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সময় যেন চলে না যায়। লালন বলেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না...।’
সময় গেলে কি সাধন হয়?
0 comments:
Post a Comment