এবার আসা যাক মারজানের কাজে। বছর তিন-চার ধরে অনলাইন আউটসোর্সিংয়ের কাজে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের খবর শোনা যাচ্ছে। গত দুই বছরে তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়েও পড়েছে। কেতাবি ভাষায় একে বলা হয় ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং। ক্ষেত্রটিতে বাংলাদেশিদের অবস্থান এখন প্রথম সারিতে। যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁরা মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বেশি পরিচিত। বিভিন্ন দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাদের কাজগুলো বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে করিয়ে নেয়। এটাই হলো আউটসোর্সিং, যার পুরোটাই হয়ে থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
মারজান আহমেদ থাকেন যশোরে। পড়েন এম এম কলেজে, ইংরেজি বিষয় নিয়ে। কিন্তু মারজানের অসাধারণত্ব অন্য জায়গায়, আউটসোর্সিংয়ে। নিজের কাজের ক্ষেত্রে মারজান বিশ্বসেরাদের দলেই আছেন।
ইন্টারনেটে যেসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের কাজ আদান-প্রদান হয়ে থাকে, সেসব সাইটকে বলা হয় ‘অনলাইন মার্কেট প্লেস।’ জনপ্রিয়তা আর কাজের দিক থেকে এসব মার্কেট প্লেসের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে ফ্রিল্যান্সার ডট কম। এ সাইটটিতে মুহূর্তে প্রায় ৭৩ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন।
মারজান আহমেদ এই ফ্রিল্যান্সার ডট কমেই মূলত কাজ করেন। আর এখানে ৭৩ লাখ ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে তাঁর অবস্থান ১৩তম। বাংলাদেশে দ্বিতীয়। ফ্রিল্যান্সার ডট কমে নারীদের মধ্যে বিশ্বে তাঁর অবস্থান এক নম্বর। কাজের পর্যালোচনা বা রিভিউ মারজানের প্রোফাইলে জমা পড়েছে দুই হাজার ৩৩৩টি। বেশির ভাগ রিভিউতে পাঁচ তারকা (ফাইভ স্টার) পেয়ে থাকেন তিনি। মারজানের প্রোফাইলে লেখা আছে, প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য তাঁর পারিশ্রমিক ১৩০ মার্কিন ডলার। অথচ এই মারজান ২০১০ সালে যখন আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন, তখন প্রথম কাজে নেতিবাচক ‘রিভিউ’ বা মন্তব্য পেয়েছিলেন। কাজের পারিশ্রমিকও পাননি। ‘প্রথম দুই মাস এমনটাই চলেছিল। তারপর ফ্রিল্যান্সার ডট কমে নিজের প্রোফাইলটা আকর্ষণীয় করে সাজাই।’ বলছিলেন মারজান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না তাঁকে। গত বছর বেসিসের ফ্রিল্যান্সার পুরস্কারও জেতেন তিনি।
মা মাকসুদা আহমেদ আর বাবা মকবুল আহমেদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে মারজান চতুর্থ। জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৩ মে। ২০০৫ সালে বাবা মারা যান। সে বছরই বিয়ে হয় মারজানের। ব্যবসায়ী স্বামী আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে চলে যান যশোর। সেখানেই উচ্চমাধ্যমিক, তারপর ইংরেজি নিয়ে এম এম কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। এর মধ্যেই মারজানের কোলজুড়ে আসে সন্তান আইমান। যার বয়স এখন পাঁচ।
বাসায় কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছিল। ওয়েবসাইটে ঘুরতে ঘুরতেই খোঁজ পান আউটসোর্সিংয়ের। শেখানোর কেউ ছিল না আশপাশে। কিন্তু নিবন্ধন করে ফেললেন ফ্রিল্যান্সার ডট কমে। ‘প্রথমে ইচ্ছা ছিল লেখালেখি করার। তাই করতাম। বিভিন্ন পণ্যের পরিচিতি বা সেটার বর্ণনা লেখার কাজ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু।’
এখন মারজান আহমেদ বেশি করেন ইন্টারনেট আর সামাজিক মাধ্যমে বিপণনের কাজ। বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বা সেবার বিপণন করতে হয় সফলভাবে। তাঁর ভাষায় এ কারণেই ‘অলওয়েজ অনলাইন’।
পড়াশোনা, সন্তান, সংসার আর নিজের পেশাগত কাজ—সময় ব্যবস্থাপনা করেন কীভাবে? ‘আসলে আমার কোনো রুটিন নেই। যখন কলেজে ক্লাস বা প্রাইভেট পড়া থাকে, সেই সময়টা বাদে বাকি সময় আমি আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতে পারি। এর মধ্যেই চলতে থাকে ছেলের দেখভাল ও অন্য কাজগুলো।’
যশোরে নিজের বাসায় ছয়টি কম্পিউটার নিয়ে কাজের জায়গা তৈরি করেছেন। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের দিয়ে করান নিজের বাড়তি কাজগুলো। ফলে কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারছেন তিনি।
‘যোগাযোগ করার ক্ষমতা আর ইংরেজিতে সাবলীল দক্ষতাটা ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।’ বললেন মারজান আহমেদ। ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রটিতেই থাকতে চান। মারজান মনে করেন, নারীদের জন্য আউটসোর্সিংয়ের কাজ সব দিক থেকে সুবিধাজনক। সাহস করে কাজ শুরু করে দিলেই হলো। ‘জাস্ট স্টার্ট ইট।’
0 comments:
Post a Comment