সংবিধান ও আইনের আলোকে ১৩ দফা পর্যালোচনা করে সরকারের এই অবস্থান নির্ধারণ করেছে আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মতামত শাখা হেফাজতের দাবিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে গত মঙ্গলবার এই মতামত চূড়ান্ত করেছে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান ও প্রচলিত আইনের আলোকে পর্যালোচনা করে আমরা তো হেফাজতের একটি দাবিও গ্রহণযোগ্য বলে দেখছি না।’
আইনমন্ত্রী বলেন, তাঁরা বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার প্রতিরোধের দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে তো আইন রয়েছে। তাঁরা নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণের বিরুদ্ধে বলেছেন। এটা তো এই যুগে সম্ভব নয়। এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক। পুলিশ, সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ দিচ্ছেন। এ ধরনের দাবি তো মধ্যযুগেরও আগের। সেটা এখন চলবে না।
হেফাজতে ইসলামের দাবি ও সরকারের অবস্থান: ১৩ দফার মধ্যে প্রথম দাবিটি হচ্ছে, সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহ-বিরোধী সব আইন বাতিল করা।
এই দফাটির পর্যালোচনায় আইন মন্ত্রণালয় ১৯৭২ সালের সংবিধানে কী ছিল, তারপর বিভিন্ন সময় কোন পটভূমিতে কী পরিবর্তন হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে পঞ্চম সংশোধনী প্রণয়নের সময় সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ সংরক্ষণ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২ক-এ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংরক্ষণ করায় সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংরক্ষিত আছে।
উক্ত প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ১২, ২৮(১) ও ৩৮-এ প্রদত্ত রক্ষাকবচের ফলে হেফাজতের ১ নম্বর দাবিটি সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ায় তা পূরণের সাংবিধানিক আবশ্যকতা নেই।
দাবি দুই—আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস।
সরকারের অবস্থান—দণ্ডবিধির ২৯৫এ এবং ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী, ওই অপরাধের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তা ছাড়া এই অপরাধের সাজা হিসেবে অধিকাংশ মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। এ অবস্থায় নতুন আইন করার কোনো আবশ্যকতা নেই।
তিন নম্বর দাবি—শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
সরকারের অবস্থান—শাহবাগে সমবেতরা ধর্মদ্রোহী বা ধর্মের অবমাননাকারী নয় মর্মে শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে দাবি করে আসছে। কিন্তু অন্যান্য জায়গা থেকে ধর্ম সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য লক্ষ করা গেছে।
এ ব্যাপারে সরকারের নয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। অন্য কেউ কারও ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হবে।
দাবি চার—ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—ব্যভিচার দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় দণ্ডনীয়। অশ্লীল আচরণের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৭৫ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। অন্যান্য মহানগর পুলিশের অধ্যাদেশেও একই বিধান আছে। অন্যদিকে সংবিধানের ১৯(৩), ৩৬ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব নাগরিকের অবাধ বিচরণ সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার ক্ষুণ্ন করে কোনো বিধান প্রণয়ন করা হলে তা সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হবে এবং সেই কারণে ৭ ও ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই বিধান বাতিল হয়ে যাবে।
তা ছাড়া নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ করা হলে সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থলসহ জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ নারী কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাতে অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা বিলুপ্ত করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন বিঘ্নিত হবে, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।
পঞ্চম দাবি—ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
সরকারের অবস্থান—প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মুসলমানদের জন্য ইসলাম এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। ইসলাম ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলে সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হবে। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংবিধানের বিধান এবং জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুযায়ী, সরকারের প্রণীত নারীনীতি ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী না হওয়ায় এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকায় নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের কারণ ও সুযোগ নেই।
দাবি ছয়—সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ধর্মচর্চার সমতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এই অধিকার ক্ষুণ্ন হলে যেকোনো নাগরিক সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। সুতরাং এসব বিধান অনুযায়ী আহমদিয়া সম্প্রদায়কে (কাদিয়ানি) অমুসলিম ঘোষণার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ নেই।
দাবি সাত—মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—সংবিধানের ২৩ ও ২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃত, বিনাশ বা অপসারণ করার সাংবিধানিক বা আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
এ ছাড়া জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন কনভেনশন এবং ইউনেসকোর কার্যক্রমের অংশীদার হিসেবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
দাবি আট—জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ সব নাগরিককে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সুযোগ দিয়েছে। সরকার নাগরিকদের এই সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন। সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় সন্ত্রাসী মুসল্লি বেশে জাতীয় মসজিদে ঢুকে খতিবকে জুমার নামাজে ইমামতি করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেন। তাঁরা মসজিদের ভেতরে জায়নামাজে আগুন ধরিয়ে দেন। এ অবস্থায় সরকার প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রকৃত মুসল্লিদের নিরাপত্তা বিধান ও সুষ্ঠুভাবে নামাজ আদায়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়।
নয় নম্বর দাবি—রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—নাটক-সিনেমায় সাধারণত সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতিফলন ঘটানো হয়। সেখানে ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় ধরনের চরিত্রই দেখানো হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে নাটক-সিনেমায় ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কিছু প্রচার করা হলে তা প্রচলিত আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ (দণ্ডবিধির ধারা ২৯৫এ)।
দাবি ১০—পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনসহ ধর্ম প্রচারেরও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্ম প্রচার বন্ধ করা ওই অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। তবে কোনো এনজিও বা মিশনারি কোনো ধর্মের প্রতি কোনো ধরনের অবমাননাকর কর্মকাণ্ড চালালে তা প্রচলিত আইনেই বিচারযোগ্য।
দাবি ১১—রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান—এ ধরনের কোনো দমন-পীড়ন, গুলিবর্ষণ বা গণহত্যার ঘটনা দেশে ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে যারা দেশে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে, তারা আলেম-ওলামা বা তৌহিদি জনতা নয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিয়েছে। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী দেশে কোনো গণহত্যা সংঘটিত হয়নি।
দাবি ১২—সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখানোসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
সরকারের অবস্থান হচ্ছে—এ ধরনের হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখানো বা ষড়যন্ত্রের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ধরনের কোনো অভিযোগও সরকারের কাছে কেউ করেনি। তবে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলে সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি ইতিমধ্যে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়া সংক্ষুব্ধ যেকোনো ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।
দাবি ১৩—অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
সরকারের অবস্থান—সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালাও-পোড়াওসহ বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে যাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাঁদের কেউই আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র বা তৌহিদি জনতা নয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো রাজনৈতিক দলের ইচ্ছাকৃত বা সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে কারও ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করলে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।
0 comments:
Post a Comment