বিবিসির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছিল। দীপু মনি ভারতের প্রচারমাধ্যমে বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি না হলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রবলভাবে ধাক্কা খাবে।’ বিবিসির প্রতিবেদক এই মন্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বলেছেন, ‘পর্যবেক্ষকদের অভিমত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এত কড়া ভাষায় কথা বলেছেন, কারণ তাঁকে জানানো হয়েছে যে তিস্তা চুক্তি আপাতত আর করা সম্ভব হচ্ছে না।’ এখন দীপু মনি যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, এ প্রশ্নটি তো সত্যিই প্রাসঙ্গিক যে, ভারতের নানা পর্যায় থেকে ‘আশ্বস্ত’ করার পরও তিস্তা চুক্তি না হলে দুই দেশের সম্পর্ক ‘প্রবলভাবে ধাক্কা খাবে’—এমন মন্তব্য করা কেন জরুরি হয়ে পড়েছিল?
আসলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাক বা না জানাক, ভারত যেহেতু জানে যে তিস্তা চুক্তিটি এখনই করা সম্ভব হবে না, তাই আশ্বস্ত করলেও তাদের তরফে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি মেলেনি। প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের আগে ৩ মে দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস কে কৃষ্ণা। উদ্দেশ্য, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতার অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা, যাতে ভালো খবর নিয়ে বাংলাদেশে যেতে পারেন প্রণব মুখার্জি। কিন্তু মমতাকে নাকি তাঁর অবস্থান থেকে সরানো যায়নি। তিস্তার ব্যাপারে খালি হাতেই বাংলাদেশে আসতে হয়েছে প্রণব মুখার্জিকে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তির ২০ কোটি ডলারই অনুদান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেলেন তিনি। বাংলাদেশ এমন কিছু আশাও করেনি। এ ঘোষণাটি ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশের চাওয়া ছিল এই ঋণ চুক্তির বিভিন্ন শর্ত শিথিল করা। তারও আশ্বাস দিয়ে গেছেন তিনি। ভারত যে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না তার ক্ষতিপূরণ হিসেবেই যেন ১০০ কোটি ডলার ঋণ অনুদানের ২০ কোটি ডলারকে শুধুই অনুদান হিসেবে ঘোষণা করে গেলেন তিনি! যে অর্থ বাংলাদেশকে আর ফেরতই দিতে হবে না।
যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে ভারত ‘আপাতত’ তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারছে না, তার মূল কারণ অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ ও এর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার যে বাংলাদেশ সফরের পর হিলারি দিল্লি গেলেন কলকাতা হয়ে, মমতার সঙ্গে বৈঠক করলেন, তার পেছনে দুটি কারণই পর্যবেক্ষকদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। একটি হচ্ছে, ভারতে খুচরা পণ্য-বাণিজ্যে মার্কিন বিনিয়োগের বিরোধিতাকারী মমতাকে রাজি করানো, যাতে ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানিগুলো ভারতে ব্যবসা করার সুযোগ পায়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে রাজি করানো। হিলারির সঙ্গে মমতার যে বৈঠক হয়েছে, তা পুরোপুরি একান্ত বৈঠক। সেখানে আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানার কোনো সুযোগ নেই। যে দুটি ইস্যুর কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি বলে মমতা পরে জানিয়েছেন। তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ হিলারির সাহায্য চেয়েছে, এমন খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি। এ অবস্থায় তিস্তা নিয়ে হিলারি আদৌ মমতার সঙ্গে কিছু বলেছেন কি না ধারণা করা কঠিন। তবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অজিতাভ রায়চৌধুরী। তাঁর মতে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম চাওয়া। ‘সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় শেখ হাসিনা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছেন এবং রাজনৈতিকভাবে তাঁর স্থিতিশীলতা অর্জনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ তাঁর মতে, তিস্তা চুক্তি করতে ব্যর্থ হলে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সুযোগ পাবে। ‘অন্যদিকে তিস্তা চুক্তি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় হাসিনার জন্য বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে এবং তাঁর ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করবে, যা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই চায়।’(টাইমস অব ইন্ডিয়া, কলকাতা, ৯ মে)
এত কিছুর পরও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এগোতে পারছে না মমতার কারণে। লোকসভায় ২০ ও রাজ্যসভায় ছয় আসন নিয়ে মমতার দল (তৃণমূল কংগ্রেস) কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) সবচেয়ে বড় শরিক। অন্যদিকে ভারতের রাজনীতিতে দিনে দিনে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব বাড়ছে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক দলকে উপেক্ষা করার শক্তি কেন্দ্রের নেই। বলা যায়, মমতার চাপ ও নানা হুমকির কাছে কেন্দ্রকে বেশ তটস্থই থাকতে হয়। গত নভেম্বরে তেলের দাম বাড়ানোর পর কোয়ালিশন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণাই দিয়ে বসেছিলেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ রিলিফ প্যাকেজ চেয়েও কেন্দ্রকে চাপে রেখেছেন মমতা। তাঁর চাপে অনিচ্ছা নিয়েও ইউনিয়ন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদিকে সরিয়ে মুকুল রায়কে মন্ত্রী করতে হয়েছে মনমোহন সিংকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য যা ছিল খুবই বিব্রতকর। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) সরকারের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। গত মার্চে উত্তর প্রদেশের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে কংগ্রেস। সামনে ভারতে যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানেও তৃণমূলের সহায়তা দরকার ইউপিএ সরকারে। ভারতে লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে। এ অবস্থায় মমতা নানা চাপ সৃষ্টি করছেন জোটের ওপর। হঠাৎ করেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ২০১৩ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক দলগুলো সর্বভারতীয় ইস্যুর চেয়ে তাদের আঞ্চলিক দাবিদাওয়া, স্বার্থ—এসবের প্রতিই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। মমতাও সেই কৌশল নিয়েছেন। তিস্তা চুক্তির বিরোধিতায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকেই তাই বড় করে তুলে ধরার পথ বেছে নিয়েছেন।
তিস্তা নিয়ে সমীক্ষা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্রকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক প্রতিবেদন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সেই প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, তিস্তা নদীর মূল অববাহিকায় পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। অববাহিকার ভারতীয় অংশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাঁধ নির্মাণের ফলে তিস্তার পানি দ্রুত কমে আসছে (প্রথম আলো, ১১ মে, ২০১২)। ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী জলপাইগুড়ির গজলডোবায় যে তিস্তা ব্যারাজ রয়েছে, এর উজানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আটটি বাঁধ নির্মাণের কথা রয়েছে। এই প্রসঙ্গে কল্যাণ রুদ্র তাঁর বাংলার নদীকথা বইয়ে আগেই লিখেছেন, ‘আটটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রূপায়িত হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারজনিত কারণে অন্তত পাঁচ শতাংশ করে অর্থাৎ মোট ৪০ শতাংশ জল হ্রাস পাবে’ (পৃষ্ঠা ৭৬)। এখানে প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী, সেখানে ৪০ ভাগ পানি কমে যেতে পারে এমন কোনো প্রকল্প বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে ভারত নিতে পারে কি না? দ্বিতীয়ত, এই পানি কমে যাওয়ার তত্ত্ব কতটুকু যৌক্তিক। এ প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের সঙ্গে। ‘তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি অভিন্ন নদী। এখানে উজানের দেশ এমন কিছু করতে পারবে না, যাতে নদীর অন্য কোনো অংশে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তিস্তা নদীতে ভারতের যেমন অবকাঠামো রয়েছে, বাংলাদেশেরও রয়েছে। আর পানি প্রাপ্যতা যেহেতু পর্যাপ্ত নয়, সে কারণে দুই দেশ মিলেই পানির ব্যবহারটি ঠিক করতে হবে।’ আইনুন নিশাতের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা কল্যাণ রুদ্র করেছেন, সেটাও তিনি মেনে নিতে চাননি। ‘নদীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলে পানি কমে যাবে বলে কল্যাণ রুদ্র যে তথ্য দিয়েছেন তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছি না। উজানে রান অব দ্য রিভার বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পানি কমার কোনো কারণ নেই। জলাধার নির্মিত হলে না-হয় পানি বাষ্প হয়ে কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেত। আমরা যেহেতু অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার পক্ষে, তাই এ ধরনের বিভ্রান্তি কাটাতে দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময় জরুরি।’
পশ্চিমবঙ্গ নিজেদের পানির চাহিদার বিষয়টি তুলে ধরে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছে। এখন ভারত সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, সিকিমের পাহাড়ে জন্ম নেওয়া এ নদীটির প্রাপ্য পানি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভাগাভাগির উদ্যোগ নেওয়া। তিস্তার যে পানি ভারত পাবে, তা সিকিমে কীভাবে ব্যবহার হবে, বিহারে সরিয়ে নেওয়া হবে কি না, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হবে কি না বা পশ্চিমবঙ্গ কতটুকু পাবে সেই মীমাংসা নিজেদেরই করতে হবে। এখন তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশ যে পানি পাবে তা পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম না লালমনিরহাটে ব্যবহার হবে বা কীভাবে ব্যবহার হবে, সেটা বাংলাদেশের বিষয়। লালমনিরহাটে পানি সরিয়ে নিলে কুড়িগ্রাম পানি পাবে না এবং কুড়িগ্রাম পানি না পেলে বাংলাদেশ চুক্তি করতে পারবে না, এটা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ চাচ্ছে না সে কারণে ভারত চুক্তি করতে পারছে না যুক্তি হিসেবে এটাও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ও নিজেদের নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ ভারতকে তিস্তা চুক্তি করতে দিচ্ছে না। কিন্তু তিস্তা চুক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও যে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশেও নির্বাচন আসছে বছর দেড়েক পর। যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দোহাই ভারত দিচ্ছে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য। ভারতকে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। তিস্তা চুক্তি না হলে ২০ কোটি ডলারের অনুদান বাংলাদেশ-ভারত সম্পকর্কে দীপু মনির ভাষায় ‘প্রবল ধাক্কা’র হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com prothom-alo
0 comments:
Post a Comment