১৯৮৪ সালে মার্কিন চিত্রপরিচালক জেমস ক্যামেরনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নির্ভর ছবি ‘টার্মিনেটর’ মুক্তি পেয়েছিল। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার অভিনীত অসম্ভব জনপ্রিয় সেই ছবিতে ক্যামেরন এমন একটি বিশেষ দৃশ্যকল্পের গল্প তুলে এনেছিলেন যেখানে দেখানো হয়েছিলো, ২০১১ সাল হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়ের শুরু। সেখানে ২০১১ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে চরিত্রকে। বুদ্ধিমান কৃত্রিম প্রাণীরা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার। এমনই এক প্রযুক্তিবিশ্বকে ক্যামেরন তার মুভিতে দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু ক্যামেরনের সে আশংকা ফলেনি। মানবজাতির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সেই আশঙ্কাকে দূরে ঠেলে ভালোয় ভালোয় আমরা পার করে এসেছি ২০১১ সাল। গত বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈপ্লবিক উত্থান না ঘটলেও অ্যাপল-এর নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের সাফল্য এসেছে। এখন দেখার বিষয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে ২০১২ সালটি আমাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে।
৪ অক্টোবর টেক জায়ান্ট অ্যাপল আইফোন ৪এস বাজারে আনে। এই স্মার্টফোনটির সঙ্গে নিয়ে আসে কৃত্রিম বৃদ্ধিমান ভার্চুয়াল সঙ্গী ‘সিরি।’ অ্যাপল-এর ‘সিরি’ নামের এই প্রযুক্তি যদিও এখনো যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে পারেনি, তবে সম্ভাবনার এক অপার দুয়ার খুলে দিয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনোযোগ দিয়ে কোনকিছু শেখার কাজটি সিরি বেশ ভালোই পারে। তবে, মানবজাতি ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কূটবুদ্ধি আপাতত সিরির ভেতরে নেই। সিরির দেখাদেখি, টেক জায়ান্ট গুগলও ঘোষণা দিয়েছে ‘আলফ্রেড’ নামের ভার্চুয়াল সঙ্গী আনার। দেখার বিষয় ২০১২ সালে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় কতোদূর এগোতে পারে ভার্চুয়াল সঙ্গীরা। সম্প্রতি, সিরির একটা কাজ সবার মনোযোগ কেড়েছে। খবরে প্রকাশ, সিরিকে অহেতুক বিরক্ত করায়, ১৬ বছরের এক ব্যবহারকারীকে গালাগাল দিয়েছে সে। সিরি মেজাজ খারাপও করে ফেলছে, তার অর্থ, সিরির মধ্যে রাগ-এর সঞ্চার ঘটেছে। এগুলো মানবীয় আবেগ। এই আবেগগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যোগ হচ্ছে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেয়েছিলো ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’ মুভিটি। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। এ ছবিতে দেখানো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতি এখনো সম্ভব না হলেও তার শুরুটা কেবল হতে পারে এ বছর। এদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার উদ্ভাবনের দাবী করে বসেছেন গবেষকরা। তবে, তবে এ বছর এই কম্পিউটারকে পরীক্ষা দিয়ে উৎরে যেতে হবে টিউরিং টেস্ট। এ পরীক্ষার সফল হলেই সম্ভবত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করবে প্রযুক্তিবিশ্ব।
উল্লেখ্য, অ্যালান টিউরিং প্রবর্তিত টিউরিং টেস্টে মাধ্যমে মানবিক বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটারের বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য করা যায়। মানুষ-এর বুদ্ধিমত্তা আর কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে পার্থক্য করতেই টিউরিং টেস্ট করা হয়। টিউরিং টেস্ট চালু হবার পরেই এ টেস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। যে, প্রশ্নটি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে আর তা হচ্ছে মানুষের মতো বুদ্ধিমান কম্পিউটার কী আদৌ তৈরি করা সম্ভব? আর যদি তা হয়ও, তবে কম্পিউটারের সঙ্গে মানুষের ম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে? এ প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন গবেষকরা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সম্ভব কিনা এ বছরের টিউরিং টেস্টেই হয়তো তার প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু কম্পিউটারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে তার আপাতত একটা উত্তর গবেষকরা দিতে প্রস্তুত।
কম্পিউটিং প্রযুক্তটি তৈরি হয়েছিলো মানুষেরই স্বার্থে, মনুষের কাজের সুবিধা করতে। তবে এখন কেবল কাজের সুবিধার মধ্যেই কম্পিউটারের ব্যবহার সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমান প্রজন্ম এমন কম্পিউটার চান, যা কাজের পাশাপাশি, তার সঙ্গ দেবে। সমস্যার বিশ্লেষণ করে সমাধান দেবে এবং সার্বক্ষণিক বন্ধুর মতো দেখভাল করবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের সঙ্গে কম্পিউটারের যে যোগসূত্র তৈরি হয়েছে তাতে মানুষের কম্পিউটার নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। মানুষ চায় তড়িৎ সমাধান আর কম্পিউটারের স্বাভাবিক জ্ঞান, যা মানুষের মতোই সহজে বুঝতে পারবে এবং শেযার করতে পারবে। আর এমন চাহিদা থেকেই রোবটসহ কিছু যন্ত্র তৈরীর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন উদ্ভাবকরা।
কম্পিউটার প্রযুক্তি এখনো মানুষের ওপর নির্ভরশীল। এখনো কম্পিউটারের যেকোন কমান্ড কোন কাজ করার আগে বার বার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে নেয়, ‘আর ইউ শিওর ইউ ওয়ান্ট টু দিস?’ তবে, আশার কথা ইনটেল, আইবিএম-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারে এমন চিপ তৈরির কাজ শুরু করেছে। এরপর হয়তো প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ফাইল, বা কমান্ডের কাজ কম্পিউটার নিজে থেকেও করতে সক্ষম হবে। কম্পিউটারে বড়ো সমস্যা হচ্ছে তথ্য চুরি হওয়া। ইতোমধ্যে টেক জায়ান্টরা পাসওয়ার্ড ব্যবস্থায় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অ্যাপ্লিকেশন বা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে বলেও জানা গেছে। কম্পিটারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এখনো নিজের সুরক্ষা নিজেকে দিতে পারে না। এই ব্যাপারেও এটি আমাদের ওপরই এখনো নির্ভরশীল। তাই বারবার পাসওয়ার্ডের শেকল পড়িয়ে আমাদেরই সেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রক্ষা করতে হয়। শুধু কী পাসওয়ার্ড? কানেকশন পাওয়ার, কন্টেন্ট, কমিউনিকেশন- সবকিছুর জন্যই কম্পিউটার আমাদের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু এ বিষয়গুলো নিয়েও কাজ চলছে। হয়তো একদিন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতোই বাস্তবে চলে আসবে বুদ্ধিমান কম্পিউটার।
গবেষকরা বলছেন, সত্যিই, কম্পিউটার যদি মানুষ হতো, তবে এর অসাধারণ কর্মদক্ষতার জন্য প্রতিবছরই হয়তো পুরষ্কৃত হতো, কিন্তু এর এইসব সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো কখনো কারও বন্ধু হতে পারতো না। সমস্যাটা আরো প্রকট হতো এখনকার সময়ের জন্য, কারণ নিত্যনতুন কম্পিউটারাইজড ডিভাইস একসঙ্গে সবাই ব্যবহার করছে এবং এরকম ডিভাইস নিত্য নতুন বজারে আসছেও। কিন্তু সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শক্তির উৎস। ডিভাইসগুলো বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ডিভাইসগুলোতে প্রয়োজন শক্তি। এই শক্তির উৎপাদন নিজে থেকে করতে পারে না কোনো ডিভাইস। গবেষকরা সেখানেও হাত দিয়েছেন। ২০১২ সালে পুরো অবস্থার উন্নতি হবে, এমনটাই ভাবছে সবাই। এ বছর কম্পিউটার কেবল তার দক্ষতা দিয়েই নয়, তার বুদ্ধিমত্তা দিয়েও আমাদের চমৎকৃত করবে- সেরকম আশা করছেন গবেষকরা।
গবেষকরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাম্প্রতিক সময়ের ভয়েস কমান্ডিং, অঙ্গভঙ্গি বা জেশ্চার বা ফেইস রিকগনিশনেশনের চেয়ে অনেক উন্নত হবে। কম্পিউটারের সেই উন্নত চিপগুলোর প্রতিটি নিউরণ এর মতো সার্কিট চিন্তা করতে শিখবে এবং সেই চিন্তা থেকেই মানুষের দেখভাল করতেও শিখবে। এটি খেয়াল করতে শিখবে, ভয়েস ওভার আইপি কলের সময় যেন নেটওয়ার্কেও সমস্যায় কানেকশন কেটে না যায়, এটি বুঝতে শিখবে ক্যমারায় কোন অ্যঙ্গেলে চেহারা সবচেয়ে ভাল দেখায়; সর্বপরি এটি বোঝা শুরু করবে আমাদেও ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দ। আর এই বুঝে ওঠার মাধ্যমেই এটি নিত্যনতুন উপায়ে আমাদেও আনন্দেও কারণ হয়ে উঠবে। ২০১২ সালে কম্পিউটার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলে আমাদের ব্যবহারিক বস্তু থেকে আমাদের সহকর্মী হয়ে উঠবে, বিনোদনের মাধ্যম থেকে বন্ধু হয়ে ওঠার পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে- সেরকম আশাই করছে সবাই।
বাড়ছে পছন্দের পরিধি। নেটবুক থেকে শুরু করে আল্ট্রাবুক, ট্যাবলেট থেকে স্মার্টফোন। হালকা-পাতলা ডিভাইস, মাল্টিটাস্কিং অপশন আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরো নতুনত্বের স্বাদ এনে দিচ্ছে। ডিভাইসগুলো ক্রমশ ছোটো এবং পকেটকবান্ধব হচ্ছে। দ্রুতগতির হচ্ছে ক্যামেরা। ডিজিটাল ক্যামেরা, ট্যাবলেট এবং নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করছে প্রযুক্তি জায়ান্টরা। আমাদের স্মরনীয় মুহুর্তগুলো বন্দী হচ্ছে ক্যামেরা ফ্রেমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে সৃষ্টিশীলতায়। ২০১২ সালটি কেমন যাবে সে বিষয়ে ভবিষ্যতদ্বাণী করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পুরোটা জুড়ে থাকবে উদ্ভাবন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, সৃষ্টিশীলতা, শেয়ার আর চমৎকার দৃশ্যপটের সম্ভাবনা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার আরো উৎকর্ষতা পাবে এবছর এমনই আশা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।
বিডিনউজটোয়েন্টিফোরডটকম
0 comments:
Post a Comment