রাজধানীর গুটি কয়েক সবুজ প্রাঙ্গণের একটি রমনা পার্কে এখন প্রতিদিন সকালে নানা বয়সী বহু মানুষের যাতায়াত। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মহিলা। তাঁরা অনেকে আসেন শরীর ঠিক রাখার জন্য হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করতে। তাঁদের বড় একটি সংখ্যা আসে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হাঁটতে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হিসাবে দেশে ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস অর্থাৎ বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত। আক্রান্তের সংখ্যা বছরে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ বাড়ছে।
সকালে পার্কে বেড়াতে আসা স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কথায়ও এই তথ্যের প্রতিফলন মেলে। গতকাল সকাল সাড়ে সাতটায় রমনায় হাঁটতে থাকা এক ব্যাংক কর্মচারী জানালেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে তাঁর বাসা। কাজের জায়গা মগবাজার। প্রতিদিন হেঁটেই অফিসে যান ও বাসায় ফেরেন। গত আট বছর এভাবেই চলছে। অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরও ধারণা ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে সকালে হাঁটতে আসা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, দেশে ২০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে গ্রামের সাত শতাংশ এবং শহরের ১০ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ২ শতাংশ হয় ডায়াবেটিসের কারণে।
রমনা থেকে সোজা সকাল আটটা নাগাদ বারডেম হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল ডায়াবেটিস রোগীদের প্রচণ্ড ভিড়। চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের দীর্ঘ সারি বিশেষায়িত হাসপাতালটির বাইরে গড়িয়েছে।
ভিড় ঠেলে হাসপাতালের নিচতলায় পৌঁছে কথা হয় মো. শাহ আলমের সঙ্গে। রাজধানীর শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা শাহ আলমের বয়স ৫৪। ২০০২ সালে জানতে পারেন তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাঁর উচ্চ রক্তচাপ, সঙ্গে কিডনিরও কিছু সমস্যা আছে। শাহ আলম নিয়মিত চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটেন। চিকিৎসকের কথামতো চলে তিনি ভালোই আছেন।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, ঘন ঘন প্রস্রাব, স্বল্পসময়ে ওজন কমে যাওয়া, তীব্র তৃষ্ণা ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, বেশি দুর্বল অনুভব করা, শরীরে ক্ষত হলে তা সহজে না শুকানো—এগুলো ডায়াবেটিসের লক্ষণ। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের হূদেরাগ, কিডনি রোগ ও স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
ডায়াবেটিস হওয়া থেকে রেহাই পেতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাজেরা মাহতাব বলেন, ‘মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।’ হাঁটাচলা ও শারীরিক সক্রিয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বললেন, শহরের মানুষ যেন প্রচুর হাঁটার সুযোগ পায় তার জন্য খোলা জায়গা বা পায়ে হাঁটার রাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যশিক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডায়াবেটিস একটি ‘লাইফ স্টাইল ডিজিজ’। অর্থাৎ জীবনযাপন পদ্ধতির কারণে এই রোগ হয়। যেমন, শারীরিক পরিশ্রম না করা, খেলাধুলা না করা, ফাস্টফুড বেশি খাওয়া, চিনিজাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ জন্য সচেতনতার বিষয়টি খুব জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জানা-বোঝা বা স্বাস্থ্যশিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সংস্থা দুটি আজ ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে প্রচারণার কেন্দ্রে রেখেছে স্বাস্থ্যশিক্ষাকে। তাতে বলা হচ্ছে, ডায়াবেটিস একটি জটিল ও জীবনব্যাপী রোগ। স্বাস্থ্যশিক্ষাই পারে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে যে কাগজপত্র পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় ডায়াবেটিসের মতো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোগ নিয়ে সরকারের পৃথক কর্মসূচি নেই। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের একটি কর্মসূচির আওতায় ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও ক্যানসারের বিষয়টি দেখা হয়। এর আওতায় ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
ডায়াবেটিক সমিতির সংবাদ সম্মেলন: ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে হলে ফাস্টফুড ও অতিরিক্ত চিনিযুক্ত বিভিন্ন কোমল পানীয়ের ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য যথেষ্ট পায়ে হাঁটার রাস্তা ও শিক্ষার্থীসহ কম বয়সীদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
গতকাল রোববার বারডেম হাসপাতালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট চিকিৎসকেরা এ কথা বলেন। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হাসপাতালে চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা, এলাকাভিত্তিক হাঁটা ও সাঁতারের ক্লাব গড়ে তুললে ডায়াবেটিস অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
সংবাদ সম্মেলনের মূল উপস্থাপনায় সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ খান বলেন, ঠিকভাবে জীবন যাপন করলে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব। তিনি বলেন, গ্রামের চেয়ে শহরে এই রোগের প্রকোপ বেশি। নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে এর প্রকোপও বাড়ছে।
এ বছরের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রতি ৮ সেকেন্ডে (সারা বিশ্বে) ডায়াবেটিসে মারা যাচ্ছে একজন। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়।’
বিশেষজ্ঞ হাজেরা মাহতাব বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বেশ উঁচু। প্রতিবছর তা এক থেকে দুই শতাংশ হারে বাড়ছে।
দিবসটি পালন উপলক্ষে ডায়াবেটিক সমিতি বিনা মূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়সহ পদযাত্রা, আলোচনা সভাসহ নানা ধরনের কর্মসূচি আয়োজন করেছে।
এ ছাড়া রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল আজ সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত স্বাস্থ্যমেলার আয়োজন করেছে। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এ মেলায় বিনা মূল্যে রক্তের শর্করা (সুগার), রক্তচাপ, ওজন মাপাসহ বিভিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। এ ছাড়া থাকবে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও তথ্য বিতরণ কর্মসূচি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান।
0 comments:
Post a Comment