যশোর সদর উপজেলার খাজুরা, চুরামনকাঠি ও হৈবতপুর; চৌগাছা উপজেলার সাদিপুর ও সাঞ্চাডাঙ্গা এবং বাঘারপাড়া, কেশবপুর, অভয়নগর, শার্শা ও মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেগুনখেতে এ জাল টানানো হচ্ছে।
অতি ক্ষুদ্র মাছও জালের ফাঁক গলিয়ে রেহাই পায় না বলে মাছ ধরতে কারেন্ট জাল ব্যবহার দেশের আইনে নিষিদ্ধ। একই কার্যকারিতার কারণে তা এখন খেতের বেড়া দেওয়ার কাজে লাগানো হচ্ছে।
সম্প্রতি যশোর সদর উপজেলার খাজুরা এলাকার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কাছাকাছি ৮-১০টি বেগুনখেতে কারেন্ট জাল টানানো রয়েছে। এর মধ্যে এক বিঘার একটি খেতে টানানো জালে ৩৫টির মতো বাদুড় ও চামচিকা জড়িয়ে ঝুলে রয়েছে। তখনো জীবিত কয়েকটি বাদুড় ডানা ঝাপটাচ্ছে।
খেতের মালিক আনোয়ার হোসেন সেখানেই ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বুলবুলি পাখির বেগুন খাওয়া ঠেকাতে হাজার চারেক টাকা খরচ করে তিনি কারেন্ট জাল টানিয়েছেন। আনোয়ার জানান, প্রতিদিন রাতে দু-চারটি বুলবুলি পাখি জালে জড়িয়ে যায়। তাঁরা সকালে ওই পাখিগুলো ছাড়িয়ে দেন। কিন্তু বাদুড় ছাড়াতে গেলে জাল ছিঁড়ে যায়। তা ছাড়া বাদুড়ে হাতে কামড়ও দেয়। এ জন্য বাদুড় ছাড়ানো যায় না। জালেই আটকে মরে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাখি ও বাদুড় মরলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, তা আমরাও জানি। কিন্তু ভাই, কী করবো কন? এইডে করেই তো পেট চলে।’
পরদিন চুরামনকাঠি ও হৈবতপুর এলাকার গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক বেগুনখেত কারেন্ট জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। মাঠে কাজ করতে থাকা ইসলাম নামের এক কৃষক বলেন, ‘ভাই, ১০ কাটা জমিতে বেগুন করিছি। এখনো ধরন আসেনি। ভাবতিছি, ওই বেগুন কী করে রক্ষা করব। সবাই তো কারেন্ট জাল দিছে। শুনতিছি, কারেন্ট জাল টানানো নিষেধ। তাহলে এখন পাখির হাত থেকে কী করে বেগুনখেত বাঁচাব? কৃষি কর্মকর্তাও সেভাবে কিছু কচ্ছে না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর যশোর জেলায় এক হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমিতে বেগুনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ২৪৫ হেক্টর।
চুরামনকাঠি বাজারের আবু সালেহ সিডসের স্বত্বাধিকারী ইউসুপ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দুই বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করেছি। পাখিতে বেগুন খেয়ে যাচ্ছে। অথচ বিবেকের তাড়নায় কারেন্ট জাল টানাতে পারছি না। আপাতত খেতের চারপাশে খুঁটি পুঁতে তাতে ঘণ্টা বেঁধে পাখি তাড়ানো হচ্ছে। তাতে তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
খেতে কারেন্ট জাল ব্যবহারে বাধা দেওয়া বা নিরুৎসাহিত করা কোনোটাই করছেন না স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর সদর উপজেলার কর্মকর্তা আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষকের ক্ষতির কথা চিন্তা করে কারেন্ট জাল ব্যবহারে আমরা আর বাঁধা দিইনি। তবে কৃষকদের বলে দিয়েছি, জালে পাখি আটকা পড়লে ছাড়িয়ে দিয়ো। এ ব্যাপারে আর কোনো উন্নত প্রযুক্তি আছে কি না, আমাদের জানা নেই।’ এই অঞ্চলের বেগুনখেতে পাখির উৎপাতকে নতুন সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন আবদুর রউফ। তিনি জানান, বছর তিনেক ধরে বেগুনখেতে পাখির আক্রমণ বেড়েছে। এটি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের দেখার বিষয় বলেও মত দেন তিনি।
এ ব্যাপারে যশোর কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রওশন আলী বলেন, কারেন্ট জালে বেঁধে পাখি বা বাদুড় মারা যাচ্ছে, এমন অভিযোগ কেউ কখনো করেনি। তাই বিষয়টি নিয়ে তেমনভাবে কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে কারেন্ট জালের পরিবর্তে নাইলনের জাল ব্যবহার করা হলে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। রওশন আলী বলেন, নাইলনের জালে প্রাথমিকভাবে একটু বেশি খরচ হলেও এ জাল তিন বছর ব্যবহার করা যাবে। অথচ কারেন্ট জাল এক বছরের বেশি ব্যবহার করা যায় না। তবে এ তথ্য এখনো কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারেন্ট জাল বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করার জন্য তিনি প্রশাসনকে তাগিদ দেন।
এ ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বেগুনের খেতে কারেন্ট জাল ব্যবহার করার কারণে পাখি মারা যাচ্ছে—এমন তথ্য কেউ জানায়নি। এ কারণেই ডাঙায় ব্যবহূত কারেন্ট জাল জব্দ বা নিষিদ্ধ করার জন্য তৎপরতা চালানো হয়নি। এ বিষয়ে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হবে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রওশন আলী জানিয়েছেন, ঢাকার গাজীপুরে অনুষ্ঠানরত কৃষিবিষয়ক জাতীয় সেমিনারে গতকাল বুধবার বিষয়টি উত্থাপন করে এ বিষয়ে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দেশ-বিদেশের কৃষি বিশেষজ্ঞরা এ সেমিনারে যোগ দেন।
0 comments:
Post a Comment