ঈদ উপলক্ষে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পরপরই বেসরকারি বাসগুলোর কাউন্টার থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ২৮ ও ২৯ আগস্টের কোনো টিকিট নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু গতকাল রোববার কল্যাণপুর, গাবতলী, মহাখালী, রাজারবাগ ও সায়েদাবাদ বাসস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ পরিবহনকর্মীরা টিকিট হাতে নিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশে হাঁকডাক ছাড়ছেন। আর বিলাসবহুল বাসের টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে।
এর বিপরীত চিত্র ট্রেনে। লোকাল, কমিউটার আর বিশেষ ট্রেনে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। আন্তনগর ট্রেনেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যাত্রীরা। সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে সব চাপ গিয়ে পড়েছে রেল ও নৌপথে। ঘরমুখী মানুষের সব স্রোত এখন কমলাপুর স্টেশন ও সদরঘাট অভিমুখে। তবে অনেক ট্রেন সময়মতো না ছাড়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে মানুষকে।
রাস্তা খারাপের খবর প্রচারের কারণে যাত্রী কমে গেছে জানিয়ে কাউন্টারের কর্মীরা দুষছেন গণমাধ্যমকে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনও গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে বলেছেন, ‘গণমাধ্যম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ জন্যই বাসে এবার যাত্রী কম।’
রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে ঘরমুখী মানুষের স্বাভাবিক ভিড় ছিল। পরিবহনকর্মীরা বলছেন, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার ভিড় কম। সড়কের দুরবস্থার কারণে মানুষ আতঙ্কে আছে। আজ সোমবার ও কাল মঙ্গলবার মানুষের চাপ বাড়তে পারে বলে আশা তাঁদের।
বাসে যাত্রী কম: বাসমালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গ্রিনলাইন, শ্যামলী, সোহাগ, হানিফ, এস আরসহ বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো ঈদে অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে। সাধারণ মানের বাসগুলো যাত্রার আগে আগে টিকিট বিক্রি করে। এবার সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সে জন্য অনেকেই অগ্রিম টিকিট কেনেনি। পথের কষ্টের কথা ভেবে অনেকে বাড়িতে ঈদ করার চিন্তাও বাদ দিয়েছে।
গতকাল গাবতলী টার্মিনালে কথা হয় ফারহানা বিশ্বাস ও জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। যাবেন মেহেরপুরে। তাঁরা পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় থাকেন। গতকাল গাবতলীতে এসেই তাঁরা টিকিট পেয়েছেন। প্রথম আলোকে বললেন, টিকিট পাওয়ার অনিশ্চয়তা আর সড়কে ভোগান্তির ভয়ে ছোট ভাই, ভাইয়ের বউ ও ছোট বোনকে নারায়ণগঞ্জেই রেখে এসেছেন।
মহাখালী টার্মিনালে নেত্রকোনার যাত্রী বিল্লাল হোসেন বললেন, ‘এক মাস আগে এই পথ দিয়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তবু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িতেই পরিবার নিয়ে ঈদ করব।’
মহাখালী থেকে ময়মনসিংহগামী এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপক আতাউর রহমান বলেন, তাঁরা কোনো অগ্রিম টিকিট দেননি। টিকিট আছে, তবে যাত্রী কম। এখনো মানুষ আতঙ্কে আছে। অনেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছেন, যাওয়া যাবে কি না?
এনা পরিবহনের টিকিট হাতে নিয়ে শহিদুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলেন, তিনি গতকালই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসেছেন। মেরামতের কারণে রাস্তায় এখন খুব বড় গর্ত নেই। তবে অসমান সড়কে বাস চলে লাফিয়ে লাফিয়ে। ভালুকা অংশ বেশি খারাপ।
নেত্রকোনাগামী ‘নেত্র’ পরিবহনের ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জানান, তাঁদের কোম্পানির ৩৫টির মধ্যে সকাল থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সাতটা বাস ঢাকা ছেড়েছে। এর মধ্যে সকালের দুটি বাসে আসন পূর্ণ হয়। বাকিগুলোতে ১০-২০টি আসন ফাঁকা ছিল।
বাড়তি ভাড়া ও হয়রানি: যাত্রী কম, সড়ক বেহাল, বাস খালি যাচ্ছে—এত কিছুর পরও যাত্রী ঠকানোর কথা ভুলছে না পরিবহনশ্রমিকেরা।
পরিবহনশ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে একাধিক কোম্পানির বাস চলে। কিন্তু ছোট জেলাগুলোতে একটি বা দুটি কোম্পানির বাস চলে। এরা ভাড়া বেশি নিচ্ছে।
যেমন: মেহেরপুরে জে আর পরিবহন একটু জনপ্রিয়। গতকাল গাবতলী টার্মিনালের প্রবেশমুখে নতুন মোড়া পেতে বসেছিলেন কয়েকজন। জানতে চাইলে ইকবাল হোসেন ও মানিক মিয়া জানান, বাসের আসন শেষ। কিন্তু এ পথে বিকল্প বাস না থাকায় মোড়াতেই আসনের সমান ৪০০ টাকায় টিকিট নিয়েছেন।
ফেরি দিয়ে যমুনা নদী পার করা হবে—এই শর্তে ফরিদপুর যাওয়ার জন্য রোজিনা পরিবহনের বাসের টিকিট কেটেছিলেন ফাতেমা বেগম। কিন্তু গাবতলী থেকে বাসে উঠে জানতে পারেন—ফেরি নয়, লঞ্চে পারাপার করা হবে। লঞ্চে পারাপারে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে বাসে উঠতে হয়। এই ঝক্কি পোহাতে হবে বলে তিনি বাস থেকে নেমে যান। কিন্তু টিকিট কাউন্টারের লোকজন তাঁকে টাকা ফেরত দিচ্ছে না। কাউন্টারে গেলে কর্মীরা দাবি করেন, ফাতেমা যে বাসের টিকিট কেটেছিলেন, সেটি আগেই চলে গেছে। পরে ধরা পড়ে, পরিবহনকর্মীর এই দাবি ঠিক নয়। শেষে ফাতেমাকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
মহাখালী টার্মিনালে ধলেশ্বরী পরিবহনে টাঙ্গাইলের ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল ১২০ টাকা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের দূরত্ব ৯২ কিলোমিটার। কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে এই পথের ভাড়া হয় ১০৫ টাকা। যাত্রী কাজী হারুন অর রশিদ বলেন, ‘যাত্রী থাকুক আর না থাকুক, ঈদ এলেই ওরা পকেট কাটা শুরু করে। এই অভ্যাস যাবে না।’ ধলেশ্বরী পরিবহনের ব্যবস্থাপক পান্নু মুন্সী পুরোনো কথা আবারও বলেন, ‘আসার সময় খালি আসে। তাই পোষানোর জন্য কিছু বাড়তি নেওয়া হয়।’
এর বাইরে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গগামী সাধারণ বাসে অপেক্ষাকৃত কম টাকায় ছাদে চড়ে যাচ্ছেন কম আয়ের যাত্রীরা।
ট্রেন: গতকাল রোববার সকালে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ট্রেনই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪০ থেকে ৮০ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন বলেছেন, রোববার সকালে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ৩৮টি ট্রেনের মধ্যে ৩৬টিই নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছে। আর বাকি দুটি ট্রেন সামান্য দেরি করেছে।
সকালে সরেজমিনে ঘুরে এবং রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন গন্তব্যের একটি ট্রেন ছাড়া বাকি সবই কমপক্ষে ৪০ মিনিট দেরি করে স্টেশন ছেড়েছে। তবে গত কয়েক দিনের ট্রেনের সময়সূচি যেভাবে হেরফের হচ্ছিল, তা অনেকটাই কমেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন ছাড়তে দুই থেকে ১১ ঘণ্টা দেরি হয়েছিল।
আজকের অফিস শেষে ট্রেনে ঘরে ফেরা যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে। সব কাউন্টারেই মূল আসনের প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ‘দাঁড়ানো টিকিট’ বিক্রি করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত যে ট্রেনগুলো ঢাকা ছাড়ে, সেগুলো হলো—রাজশাহীগামী ধূমকেতু, খুলনাগামী সুন্দরবন, সিলেটগামী পারাবত, নোয়াখালীগামী উপকূল, দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা ও চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতি। এ ছাড়া সারা দিনে ২৪টি আন্তনগর, আটটি মেইল ট্রেন, ছয়টি বিশেষ ট্রেন এবং চারটি কমিউটার ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করেছে।
তবে সব কষ্ট ছাপিয়ে যাত্রীদের চোখেমুখে ছিল খুশির আভা। বিশেষ করে শিশুরা যেন ছিল আনন্দে আত্মহারা। অনেক কষ্টে চট্টগ্রামে যেতে তিনটি ‘দাঁড়ানো টিকিট’ সংগ্রহ করেছেন শাহজাহানপুরের আলী আব্বাস। তিনি বলেন, ‘দাঁড়িয়ে গেলেও তো বাড়িতে পৌঁছে যাব।’
দেওয়ানগঞ্জের ট্রেন ছাড়তে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা দেরি হলেও সমস্যা মনে করছেন না নাছের আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আরে, ট্রেনে তো উঠে বসেছি। একসময় তো ঠিকই পৌঁছে যাব।’
প্ল্যাটফর্মের নোংরা ও অস্বস্তিকর পরিবেশেও ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। আরিফা সুলতানা সাড়ে সাতটার গাড়ির জন্য ভোর ছয়টায় এসেছেন। তিনি বলেন, ‘অল্প কিছুক্ষণে আমার তেমন কোনো খারাপ লাগছে না।’ তবে বৃদ্ধ মায়ের জন্য কিছুটা চিন্তিত ছিলেন তিনি।
স্টেশনে হকারদের তেমন কোনো উৎপাত না থাকলেও পকেটমারেরা বেশ সক্রিয়। বেশ কয়েকজন যাত্রী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, এ নিয়ে রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা কথা বলতে রাজি হননি।
0 comments:
Post a Comment