গতকাল শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাবেয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার মাস তো এ নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু একদিন এক মুরব্বি বলেন, শিশুটি মেয়ে না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। শেষে আট মাস বয়সে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি।’
শিশুটির বয়স এখন দুই বছর চার মাস। হাসপাতালের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এ সময়ে তার দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। গত সপ্তাহে শিশু সার্জারি বিভাগে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। শিশুটির পরিচয় নিয়ে এখন আর দ্বন্দ্ব নেই। সে এখন ছেলে। তার নাম রাখা হয়েছে রাব্বি।
হাসপাতালের চিকিৎসক দলের প্রধান ও শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান আশরাফ উল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে বা মেয়ের দ্বন্দ্ব বৈজ্ঞানিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আমরা তা-ই করেছি।’ তিনি বলেন, যত কম বয়সে এ চিকিৎসা করা হবে, ততই ভালো।
আশরাফ উল হক বলেন, শরীরে ছেলে বা মেয়ের গুণ সুস্পষ্ট না হলে সমাজ তাকে ভিন্নভাবে দেখে। এরা ট্রান্সজেন্ডার। সমাজে এরা হিজড়া পরিচয় পায়। হিজড়া শিশুর জন্ম হলে পরিবারে দুঃখ নেমে আসে। অনেকে শিশুটিকে ত্যাগ করে।
রাবেয়ার এই শিশুটির লিঙ্গ-পরিচয় জানার জন্য চিকিৎসকেরা তার পেটের ভেতর, প্রস্রাবের নালিসহ অন্যান্য প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করেন। তাঁরা নিশ্চিত হন, শিশুর শরীরে নারীর নির্দিষ্ট কোনো প্রত্যঙ্গ নেই। আশরাফ উল হক বলেন, ‘শিশুটি পুরুষ, তবে তার পুরুষ প্রত্যঙ্গগুলো ঠিকমতো বিকশিত হয়নি, দু-একটি প্রত্যঙ্গ যথাস্থানে ছিলও না।’
তারপর মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ড শিশুটির ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত দেয়। ডিএনএতে নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট থাকে (নারীর ক্ষেত্রে এক্সএক্স, পুরুষের ক্ষেত্রে এক্সওয়াই)। ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায়, শিশুটি পুরুষ।
নারীবাদীরা যেন অভিযোগ করতে না পারেন যে, নারী শিশুকে পুরুষ বানানো হয়েছে, সে জন্য ডিএনএ পরীক্ষা জরুরি ছিল বলে চিকিৎসকেরা জানান।
এরপর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। শিশুটিকে পুরুষ হরমোন দেওয়া হয়। তাতে ভালো ফল পেয়ে তার অণ্ডকোষটি অস্ত্রোপচার করে যথাস্থানে আনা হয়। নালি যথাস্থানে বসিয়ে প্রস্রাবের ব্যবস্থা করা হয়। আর নারীর প্রত্যঙ্গের মতো দৃশ্যমান প্রত্যঙ্গ ফেলে দেওয়া হয়। আশরাফ উল হক বলেন, ‘এখন সে পুরুষ।’
এই অস্ত্রোপচারের গুরুত্ব কী? দেশে আগেও ছেলে থেকে মেয়ে বা মেয়ে থেকে ছেলে হয়েছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিশুটির বয়স ২৮ মাস। এর মধ্যে ২০ মাস সে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে আছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ি গেছে, আবার এসেছে। শুধু একটি শিশুর পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসকেরা এ কাজ করেননি। এ ধরনের শিশুদের লিঙ্গ-পরিচয় ঠিক করে দেওয়ার ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা গড়ে তোলাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। অস্ত্রোপচারে বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও অংশ নেন। এর ফলে এ দেশের চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে।
শিশুর মা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘যখন প্রথম জানতে পারি, আমার মেয়েটি মেয়ে না, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বাচ্চাটা বড় হয়ে দুঃখে পড়বে।’ সেই মনঃকষ্ট এখন আর রাবেয়ার নেই।
পরিচয়ের দ্বন্দ্ব নিয়ে আরও তিনটি শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে। এ ধরনের শিশুর পুরো চিকিৎসা-পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আজ রোববার একটি বৈজ্ঞানিক সেমিনার হওয়ার কথা রয়েছে।
0 comments:
Post a Comment