সংগীত এবং ভাস্কর্য—শৈল্পিক সৃজনশীলতার এই দুটো প্রকাশ মাধ্যম—প্রথম আধুনিক মানুষের মধ্যে যেন হাত ধরাধরি করে উদয় হতে শুরু করে, ঠিক যখন তারা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।
পুরাতত্ত্ববিদেরা প্রথমে একটা হাড়ের তৈরি আড় বাঁশি এবং আইভরির তৈরি আড় বাঁশির দুটো টুকরো খুঁজে পান। পরীক্ষা করে তাঁরা জানালেন, এগুলোকে প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি থেকে আসা প্রথম সংগীত রচনার উপকরণ হিসেবে গণ্য করতে হবে। তাঁরা বললেন, হাড়ের তৈরি পাঁচ ফুটোঅলা বাঁশিটি, যেটা উলম শহরের পশ্চিমদিকের পাহাড়ি গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে, এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত, প্রায় অক্ষতই বলা যায়। সেই থেকে প্রতিবছরই ওই এলাকায় আরও বাঁশির টুকরো পাওয়া যাচ্ছে।
বছর কয়েক আগে, অন্য এক গুহার ভেতর, বিলুপ্ত লোমশ হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি তিন ফুটোঅলা আরেকটা বাঁশি পাওয়া গেছে, সঙ্গে ছিল ইউরোপীয় রাজহাঁসের ডানার হাড় দিয়ে বানানো আরও দুটো আড় বাঁশি। ওই একই গুহায় আর্কিওলজিস্টরা পশুপাখির ভাস্কর্য খুঁজে পেয়েছেন।
তবে এর আগে পর্যন্ত পাওয়া আর্টিফ্যাক্ট খুবই বিরল ছিল এবং সংগীতের সূচনা লগ্নের উপকরণ হিসেবে দাবি করার জন্য যতটা নিখুঁতভাবে সেগুলোর সময়কাল নির্ধারণ করা উচিত ছিল, তা সম্ভব হয়নি। এর আগে, নিরেট প্রমাণসহ সবচেয়ে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র পাওয়া গেছে এ রকম দাবি আসে ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়া থেকে, তবে সেগুলোর কোনোটাই ৩০ হাজার বছরের পুরোনো নয়, আরও অনেক কাছাকাছি সময়ের।
নেচার পত্রিকার অন লাইন সংস্করণে প্রকাশিত নিবন্ধে টুবিনজেন ভার্সিটির নিকোলাস জে. কোনার্ড এবং তাঁর সহকর্মীরা লিখেছেন, ‘এই আবিষ্কার প্রমাণ করে আধুনিক মানুষ ইউরোপকে কলোনি বানানোর ওই যুগে সুপ্রতিষ্ঠিত সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের উপস্থিতি ছিল।’
৩০ হাজার বছরের বেশি পুরোনো রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতি নিখুঁতভাবে কাজ না-ও করতে পারে, এটা মাথায় রেখে হাড় এবং সংশ্লিষ্ট নমুনা স্বাধীনভাবে দুটো আলাদা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানো হয়েছে, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে, দুই রকম পদ্ধতিতে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে একমত হওয়া গেছে ওগুলো কমপক্ষে ৩৫ হাজার বছরের পুরোনো। এমনকি তার কিছু বেশিও হতে পারে।
পুরাতত্ত্বের প্রফেসর ডক্টর কোনার্ড জার্মানি থেকে একটা ই-মেইল মেসেজে বলেছেন, ‘নতুন এই আড় বাঁশি খুব সম্ভবত ৪০,০০০ বছরের পুরানো এবং ওই এলাকায় বসতি স্থাপনের প্রথম পর্বের কাল নির্ণয় করছে।’
ডক্টর কোনার্ডের টিম জানিয়েছে, ওই জায়গার চারপাশে, আড় বাঁশিটির সঙ্গে, আইভরি আর পাথরের বিপুল আর্টিফ্যাক্ট, ভাঙা পাথরের স্তূপ, এবং শিকার করা পশুপাখির অনেক হাড় পাওয়া গেছে। ইউরোপে আসার পর প্রচুর লোকজন ওখানে বসবাস এবং কাজকর্ম করত, সময়টা ছিল আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে, স্থানীয় নিয়্যানডারথাল মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ১০ হাজার বছর পর।
নিয়্যানডারথালরা, মানবজাতির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এমন কোনো নিরেট প্রমাণ রেখে যায়নি, যা দেখে বলা যাবে সংগীতপ্রিয় ছিল তারা।
পুরাতত্ত্ববিদদের দৃষ্টিতে নতুন এসব আর্টিফ্যাক্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্য রয়েছে ফাঁপা ওই আড় বাঁশিটির, যেটা ইউরোপীয় শকুনের হাড় দিয়ে তৈরি। গুহাগুলোয় ওই শকুনের প্রচুর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। বাঁশিটির অক্ষত অংশটি সাড়ে আট ইঞ্চি লম্বা, শেষপ্রান্তে সুরস্রষ্টা যেখানে ফুঁ দেবেন, সেই ফুটোটাসহ। কারিগর ওখানে গভীর, V আকৃতির দুটো দাগ কেটেছেন আর আঙুলের জন্য ফুটোগুলোর কাছে টেনেছেন সূক্ষ্ম চারটে রেখা। অপর প্রান্তটা দেখে ভাঙা বলে মনে হয়, তার কারণ ওই শকুনের হাড় সাধারণত আরও অনেক লম্বা হয়—দুই কি তিন ইঞ্চি গায়েব হয়ে গেছে।
ওই উলমের কাছেই একটা গুহায় ২০০৪ সালে আইভরির তৈরির সাত ইঞ্চি লম্বা এবং তিন ফুটোঅলা একটা বাঁশি আবিষ্কার করেন ডক্টর কোনার্ড, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুসন্ধানের এলাকা আরও বড় করেন, ওই সময় তিনি বলেছিলেন যে দক্ষিণ জার্মানি ‘সম্ভবত সেই জায়গাগুলোর একটা, যেখান থেকে মানবজাতির সংস্কৃতি যাত্রা শুরু করে।’
ফ্রেডারিক সিবার্গার, প্রাচীন সংগীত সম্পর্কে একজন জার্মান বিশেষজ্ঞ, কাঠ দিয়ে আইভরি বাঁশিটির একটা নকল তৈরি করেছেন। ওটার সাহায্যে পরীক্ষা করে তিনি দেখিয়েছেন, প্রাচীন বাঁশি যত ধরনের সুর সৃষ্টি করতে পারছে, আধুনিক বাঁশির সুরের সঙ্গে সেগুলো তুলনা করা যায়। ‘এই সুর যথেষ্ট মিষ্টি,’ বলেছেন তিনি।
পরে পাওয়া আড় বাঁশিটির এখনো কোনো নকল তৈরি করা না হলেও, পুরাতত্ত্ববিদেরা বলেছেন, পাঁচ ফুটোঅলা বাঁশির বেড় বেশি হওয়ায় ওটা থেকে আরও অনেক সুর বৈচিত্র্য আশা করছেন তাঁরা।
কাকতালীয়ই বলা যায়, বিশাল স্তন নিয়ে যে নগ্ন নারীমূর্তিটি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটাও ওই ৩৫ হাজার বছরের পুরোনো, তার মাত্র কয়েক ফুট দূরে একই পাতালিক স্তূপ থেকে পাওয়া গেছে আড় বাঁশিটি। এ থেকে কি ধরে নেওয়া যায় শিকার করে ফেরার পর ওটা ছিল তাদের আনন্দ করার সময়? জার্মান পুরাতত্ত্ববিদেরা ধারণা করছেন, প্রস্তর যুগের সংগীতচর্চা বড় আকারের সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে এবং সম্ভবত আধুনিক মানুষের রোগ-শোক, জন্ম-মৃত্যু, অভিবাসন ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে, উৎসাহিত করেছে আরও বড় এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment