—জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সবিনয়ে আপনাকে জানাতে চাই, আমরা হতাশার কথা বলি না। আমাদের ক্ষমতায় যাওয়ারও খায়েশ নেই। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক ভালো দেখলে আমরা নিঃসন্দেহে আহ্লাদিত হই। খারাপ হলে ব্যথিত হই এবং লিখে সেই বেদনার কথা দেশবাসীকে জানাই। রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে আশ্বস্ত হই। যেমনটি হয়েছিলাম স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়, যেমনটি হয়েছিলাম সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাসের দিনটিতে। আর তাঁরা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলে উদ্বিগ্ন হই—দেশ আরেকবার সংঘাতে যাবে এই আশঙ্কায়।
দুই দশকের গণতন্ত্র ও আমরা
আপনারা যাঁরা সরকারি দলে আছেন, যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে (মাঝখানে জরুরি সরকারের দুই বছর বাদে) পালা করে দেশ শাসন করে আসছেন। আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী, তিনি (খালেদা জিয়া) বিরোধীদলীয় নেতা। গতবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আপনি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। আজ আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিরোধীদলীয় নেতাও সেই ভাষায় কথা বলতেন। এবং আজ তিনি যে ভাষায় কথা বলছেন, বিরোধীদলীয় নেতা থাকতে আপনিও সেই ভাষায় কথা বলতেন। আমরা এই স্ববিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোর কথা বলি। সবাই মিলে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করার কথা বলি। সেসব কথা কারও ভালো লাগতে পারে, না-ও লাগতে পারে। তবে আমাদের বলে যেতে হবে।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি (খালেদা জিয়া) আজ জামায়াতের হাত ধরেছেন, আর ক্ষমতায় আসার জন্য আপনিও স্বৈরাচারের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের মনে আছে, আগেরবার আপনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘সব চোর’ এক হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ঐক্য করেছিল। চারদলীয় ঐক্যজোট। পরে সেই ঐক্য ভেঙেও যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখন আপনিই বলুন, সব চোর কি এক জায়গায়, না দুই জোটে ভাগাভাগি হয়ে গেছে? চরম রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও কি এ দলের ‘মামু’, ও দলের ‘খালুরা’ একসঙ্গে ব্যবসা করছে না? শেয়ারবাজার লুণ্ঠনেও কি দুই দলের রাঘববোয়ালরা জড়িত নয়? এসব কথা বলা কি হতাশা ছড়ানো?
আপনি বলেছেন, সাংবাদিকেরা, বুদ্ধিজীবীরা সরকারের কোনো ভালো কাজের প্রশংসা করে না। এ কথাটিও কতটা ঠিক? গত বুধবারের কালের পুরাণে লিখেছিলাম, সরকার যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে, জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, তার প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন আছে।
বাংলাদেশের ‘ওয়াল স্ট্রিট’
প্রধানমন্ত্রী যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্বশান্তির মডেল উপস্থাপন করেন, তার সঙ্গেও আমরা দ্বিমত করি না। শুধু বলি, শান্তির মডেলটি দেশেও একবার প্রয়োগ করুন। শান্তির পূর্বশর্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সমতা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ উন্নত বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ একাট্টা হয়েছে, ৯৯ শতাংশের ওপর এক শতাংশের জবরদস্তির অবসানে বিশ্বের বড় বড় শহরে আন্দোলন হচ্ছে। তারা স্লোগান তুলেছে, ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো।’ বাংলাদেশেও যারা অবৈধ পথে ‘ওয়াল স্ট্রিট’ গড়ে তুলেছে, যারা শেয়ারবাজার লুট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যে লাখো মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী? মতিঝিল এখন আর বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, খুদে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের স্থায়ী ‘হাইডপার্ক’ হয়েছে।
আমরা এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন করছি। কীভাবে? এই ডিসেম্বরে বিরোধী দল আরও এক দিন হরতাল দিয়ে সরকারের ‘পোড়ামাটি অর্থনীতি’কে আরেক ধাপ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারও গায়ের জোরে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করল। সিটি করপোরেশন ভাগ না করেও সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায়, সেই কথা মানতে তারা নারাজ। বাংলাদেশ হলো সব পেয়েছির দেশ।
কার গণতন্ত্র, কেমন গণতন্ত্র?
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও সমতা। পর্বতপ্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য বজায় রেখে কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আজ ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে অঢেল সম্পদ, আর গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। এর জন্যই কি এ দেশের মানুষ একাত্তরে সর্বস্ব ত্যাগ করেছিল? ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়েছিল? বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, গ্রাম-গঞ্জের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তিনি যে ‘চাটার দল’ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন, তারাই কি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জেঁকে বসেনি? আজকের আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে সেই মূঢ় ম্লান মুখের বদলে হঠা ৎ ধনী হওয়া এবং বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত কতগুলো রোবট মানুষ দেখি। দেশ, জনগণ এমনকি দলের কর্মীদের সঙ্গেও যাদের সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগে ব্যবসায়ী-বহিরাগতদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। বর্তমান সংসদে ৬৪ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী, তাঁদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগের। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ভালোই জানেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কেন রাজনীতি করেন। কেন দল বদল করেন। আজ প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে এমন সব ব্যবসায়ী নেতাও আছেন, যাঁরা এক দশক আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করতেন, আওয়ামী লীগের সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গাল দিতেন। ব্যাংকের টাকা লোপাট করে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ওপর চড়াও হতেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কতদূর?
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা হতাশা ছড়ায় না। বরং তারা বেশিমাত্রায় আশাবাদী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে, কৃষকেরা আশাবাদী। বৃষ্টিতে ফসল ডুবে যায়, খরায় পুড়ে যায়, সার আনতে গিয়ে গুলি খায় (স্মরণ করুন খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারেরর কথা) তার পরও কৃষকেরা আশায় বুক বেঁধে আবার ফসল ফলায়। নির্বাচনে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের কথায় আস্থা রেখে, দলীয় ইশতেহারকে বেদবাক্য মনে করে ভোটকেন্দ্রে যায়। অনেকে কবি শামসুর রাহমানের মতো বিবেককে লাঞ্ছিত করেও ‘লোকে যাকে খারাপ বলে’ সেই ধরনের প্রার্থীকে ভোট দেয় এই আশায় যে সরকার অন্তত দেশটির উন্নতি করবে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কিছু কাজ করবে। কিন্তু মেয়াদের তিন বছরে এসে যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলে, তখন তাঁরা হতাশ না হয়ে পারে না।
দেশের মানুষ যেমন জঙ্গিতন্ত্র চায় না, বোমা-গ্রেনেডে রক্ত ঝরাতে চায় না, তেমনি গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তি বা দলের খেয়ালখুশি অনুযায়ী দেশ চলুক তা-ও আশা করে না।
অর্থনীতিবিদেরা, গবেষকেরা এত দিন হূষ্টচিত্তে বলে আসছিলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থা ৎ এক-তৃতীয়াংশের নিচে। কিন্তু বুধবার এক মন্ত্রী সেমিনারে যে তথ্য দিয়েছেন, তা রীতিমতো আরো উদ্বেগজনক। তিনি বলেছেন, দারিদ্র্যের হার এখনো ৪০ শতাংশ। স্বাধীনতার ৪০ বছরে এসেও ৪০ শতাংশ মানুষ সব ধরনের মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২৫ শতাংশ মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য। এর পরও রাজনীতিকেরা নিজেদের কৃতিত্ব-মাহাত্ম্য নিয়ে বড়াই করেন!
প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের আগেই ডিজিটাল বাংলাদেশ করে ফেলবেন বলে দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এই ৪০ শতাংশ মানুষ যে অ্যানালগের সীমা পার হতে পারেনি, তাদের কী হবে? স্বাধীনতার ৪০ বছরে এসেও শিক্ষার হার ৫৩ শতাংশের ওপরে ওঠানো যায়নি। এটি কি সরকারের, রাষ্ট্রপরিচালকদের ব্যর্থতা নয়? এই দুর্ভাগা ও ক্ষুধার্ত মানুষের দেশ তৈরির জন্যই কি ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল? বঙ্গবন্ধু জনসংখ্যাকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর বহুল বিতর্কিত দ্বিতীয় বিপ্লবেরও অন্যতম কর্মসূচি ছিল জনসংখ্যা কমানো। কিন্তু বর্তমান সরকার এটিকে সমস্যাই মনে করছে না। এই হলো পিতা ও কন্যার পার্থক্য!
একটি ব্যর্থ সরকার চাই
গত ৪০ বছরে আমরা অনেক সরকার দেখেছি। পুরো গণতান্ত্রিক, অর্ধগণতান্ত্রিক, সিকি গণতান্ত্রিক, পুরো স্বৈরতান্ত্রিক, অর্ধস্বৈরতান্ত্রিক, পুরো সামরিক, আধা সামরিক—হরেক নামে তাদের অভিহিত করা যায়। কিন্তু তারা কেউ ব্যর্থ হয়নি। সবাই সফলতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে। বছরের পয়লা জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি কিংবা সরকারের বছরপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তাতে নিঃসন্দেহ যে এ রকম দ্বিতীয় সফল সরকার পৃথিবীতে নেই। এত সাফল্য, এত কৃতিত্ব, এত উন্নতি, এত সমৃদ্ধি দেশের সাধারণ মানুষ বহন করতে পারছেনা।
তাই, আসুন, আজ আমরা একটি ব্যর্থ সরকারের জন্য প্রার্থনা করি। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা ভুল করবেন, সাংসদেরা ভুল করবেন এবং সেই ভুল শোধরানোরও চেষ্টা করবেন। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন। সবাইকে ভালোর সার্টিফিকেট দেবেন না।
ভারতের অর্থনীতি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ নয়। তার পরও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় দাঁড়িয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন, ভারতের অর্থনীতি এক কঠিন সময় পার করছে। তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিরোধী দলসহ সবার সহযোগিতা চেযেছেন। অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামরুন। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও মার্কিন বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। তাঁদের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সরকার দেশ চালাতে কারও পরামর্শ নেয়না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ—কেউ কখনো ভুল করেন না। তাঁরা শতভাগ নির্ভুল! শতভাগ সফল!
খালেদা জিয়ার আমলে দেশবাসী বোমা-গ্রেনেডবাজি চললেও, তাঁর সরকার সফল। শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর কাজ আটকে গেলে কিংবা ক্রসফায়ারে নিরীহ মানুষ মারা গেলেও তারা সফল। এ রকম সফল ও কীর্তিমান সরকার দ্বিতীয়টি নেই!
গত ৪০ বছর ধরে আমরা সফল ও কীর্তিমান সরকার দেখতে দেখতে ক্লান্ত।
এখন একটি ব্যর্থ সরকার চাই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment