জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের কারণে সে দেশে বিপজ্জনক মাত্রায় তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে বাহিত হয়ে এ তেজস্ক্রিয়া বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথাও শোনা গেছে গতকাল মঙ্গলবার। এ সংক্রান্ত সতর্কতার কথা জানিয়ে মোবাইল ফোনে অনেকে বার্তা পেয়েছে বলেও জানা গেছে। কিন্তু জাপান থেকে তেজস্ক্রিয়া বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে আসার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদউদ্দিন আহমেদসহ আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে ড. ফরিদ বলেন, 'জাপানে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে পূর্ব দিকে, আর বাংলাদেশ রয়েছে পশ্চিমে। এ অবস্থায় ওই তেজস্ক্রিয়তা সেখান থেকে পাঁচ-ছয় হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে আসার কোনো আশঙ্কা নেই।'
শুক্রবার জাপানে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৮.৯ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের পর দেশটির উত্তর-পূর্ব উপকূলীয় এলাকার ফুকুশিমা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সুনামিতে। গত চার দিনে ফুকুশিমার দাইচি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি চুলি্লতে বিস্ফোরণ ঘটে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জাপানে ওই বিস্ফোরণের আগে বাংলাদেশের বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা যে পরিমাণ ছিল, এখনো তা-ই রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'এ ঋতুতে বাংলাদেশে দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয়। কিন্তু জাপান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। তাই বাতাসের মাধ্যমে আমাদের এখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই।'
একই তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি বলেন, জাপান বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এত দূর থেকে বাংলাদেশে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবের কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ ছাড়া প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের সমুদ্রস্রোতের মধ্যে কোনো মিল নেই। তাই সমুদ্রস্রোতের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা বঙ্গোপসাগরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মোহাম্মদ শাহ আলম জানান। তবে উপদ্রুত এলাকার উৎপাদিত কোনো খাদ্যদ্রব্য বাংলাদেশে আনা হলে খাদ্য প্রক্রিয়ার (ফুড চেইন) মাধ্যমে তা আসতে পারে। আর ফুড চেইন অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে জানান আবহাওয়াবিদ শাহ আলম।
এদিকে গতকাল দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকদের অনেকে বার্তা পেয়েছে_জাপানে পারমাণবিক চুলি্ল বিস্ফোরণের প্রভাবে বাংলাদেশে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। হতে পারে এসিড বৃষ্টি। মাথার চুল পড়ে যেতে পারে, ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও ওই বার্তায় সতর্ক করা হয়। এসব বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বৃষ্টিরোধক ব্যবস্থা নিতেও পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিতে চাননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষক। পরমাণু বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই অধ্যাপক কালের কণ্ঠকে বলেন, জাপানে ওই বিস্ফোরণের কারণে তেজস্ক্রিয়তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আকারে বায়ুমণ্ডলে মিশে গেছে এবং বায়ুতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘটনাস্থল জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে আড়াই শ কিলোমিটার দূরে হলেও টোকিওতে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সাবেক শিক্ষক বলেন, ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের চেরনোবিলের পরমাণবিক দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তা বাংলাদেশেও ছড়িয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ওই দুর্ঘটনার কথা প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি। পরে নরওয়েতে বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর বিষয়টি ধরা পড়ে। বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলেও ওই তেজস্ক্রিয়তা চলে আসে; কিন্তু তা ক্ষতিকর মাত্রার ছিল না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ক্ষতিকর মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা বাতাসে চলে এলে তা বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে চলে আসে। ঘাস থেকে সে তেজস্ক্রিয়তা ফুড চেইনে চলে আসে।
জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না, তা জানার জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনকে নিয়মিতভাবে বাতাস পরীক্ষার কাজটি করে যেতে হবে বলে মনে করেন ওই শিক্ষক।
সে ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'অবশ্যই রয়েছে। তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। অহেতেুক আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম থেকে কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, মোবাইল ফোনে সতর্কতা বার্তা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী অশেষ পুরোহিত। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ঘটাতে পারে_এ আশঙ্কায় বৃষ্টি থেকে কিংবা দূষিত বাতাস থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে পরিচিতজনরা একে অন্যকে বার্তা পাঠাচ্ছে। মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে বার্তা পাঠানো হচ্ছে।
প্রতিবেদক বলেন, 'চট্টগ্রামের সানসাইন স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বার্তা পেয়ে শিক্ষার্থীদের বৃষ্টি হলে স্কুলে আসতে নিষেধ করেছে।'
গতকাল দেশের উপকূলীয় এলাকা পিরোজপুর, ভোলা ও বরিশাল এলাকায় বৃষ্টি হওয়ায় এবং ঢাকার আকাশে মেঘ দেখা যাওয়ায় মানুষের মধ্যে আশঙ্কা আরো বাড়ে। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে কালবৈশাখীর প্রভাবে। এ বৃষ্টির সঙ্গে জাপানের তেজস্ক্রিয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো এসিড বৃষ্টিও বাংলাদেশে হওয়ার আশঙ্কা নেই।
0 comments:
Post a Comment