আমরা তা-ই, যা আমরা খাই।
সেই মাছ-মাংস-শাকসব্জিই তো। এ-ই তো খেয়ে আসছে মানুষ। তারপরও মানুষে মানুষে এতো ভেদাভেদ কেন?উত্তর মিলবে মশলায়।কিছুদিন আগ পর্যন্তও মশলা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। মশলার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভেদজ্ঞান এখনও হয়নি। তবে মনে হচ্ছে এই মশলাই আমাকে আমি করে তুলেছে। কারণ আমি তা-ই, যা আমি খাই।তবে মশলামূর্খ কি আমি একাই? আমার মতো দু'চারজন কি নেই এই বিশাল পৃথিবীতে? নিদেনপক্ষে সচলায়তনের পাঠককূলের মধ্যে?
আসুন শুরু করি দারচিনি দিয়ে। এই দারচিনির লোভেই ইয়োরোপীয়রা রাস্তা শুঁকতে শুঁকতে হানা দিয়েছিলো ভারতবর্ষে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cinnamomum zeylanicum, কারণ তা এককালে কেবল সিলোনে (শ্রীলঙ্কা) মিলতো। আরবরা এককালে দারচিনির একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ইয়োরোপ আর চীনে। তাদের গল্পটা ছিলো এমন, দারচিনি পাখি বলে একটা পাখি আছে, যা দূর দেশের অজানা সব জায়গা থেকে দারচিনির কাঠি এনে বাসা বোনে। আরবরা সেই বাসা খুঁজে খুঁজে বার করে দারচিনি জড়ো করে বিক্রি করে। এই গল্প চতুর্দশ শতকের শুরু পর্যন্ত খেয়েছে লোকে।তারপর ধরুন এলাচ, Elettaria cardamomum। আমরা যদিও একে রান্নায় ব্যবহার করি, বা চা-য়ে খাই, আরব আর তুরস্কে লোকে একে হুঁকোতেও ফিট করে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এর ব্যবহারের প্রাধান্য ভেষজ ঔষধে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও নেপাল ছিলো এলাচ উৎপাদনে শীর্ষে, এখন এগিয়ে গেছে গুয়াতেমালা। ২০০৭ সালে তারা ১৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলাচ রপ্তানি করেছে।
জ্যাঠা প্লিনি (Pliny the Elder) গজগজ করে বলেছিলেন, "এমন কোন বছর নেই যে ভারতবর্ষ রোমান সাম্রাজ্যের ট্যাঁক থেকে পাঁচ কোটি সেস্টারশিয়াস খালি করে নেয় না।" অভিযোগ ছিলো লবঙ্গের বিরুদ্ধেই। বহু প্রাচীন কাল থেকেই লবঙ্গ, Eugenia aromaticum, ইউরেশিয়া জুড়ে সমাদৃত ছিলো, এমনকি খ্রিষ্টপূর্ব ১৭২১ সালের একটি সিরীয় মাটির জারে লবঙ্গ পাওয়া গেছে। তবে এর উৎপত্তিস্থল ভারতবর্ষে নয়, ছিলো ইন্দোনেশিয়ার অল্প কয়েকটি দ্বীপে (আজকের মালুকু দ্বীপপুঞ্জে), যেগুলো মশলাদ্বীপ নামে পরিচিত ছিলো। সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটেনে লবঙ্গের দাম ছিলো কমপক্ষে সমান ওজনের সোনার দামের সমান। লবঙ্গ শুধু স্বাদেই চমৎকার নয়, এটি নানা পৈটিক গিয়ানজাম সারায় (বিশেষ করে কৃমি)। জিরা (Cuminum cyminum) তো আরো খান্দানি জিনিস। সেই প্রাচীন সুমেরিয় সভ্যতার সময় থেকে জিরা ডানে বামে ছড়িয়ে পড়েছে। লোককথা অনুযায়ী জিরার উৎপত্তিস্থল পারস্যের কেরমুন এর আশেপাশে, ফার্সিতে তেলা মাথায় তেল ঢালার সমার্থ বাক্য হচ্ছে কেরমুনে জিরা নিয়ে যাওয়া। জিরা ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে মেক্সিকো পর্যন্ত বিপুল জনপ্রিয়। জিরা উৎপাদনে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, পাকিস্তান আর তুরস্ক।ম্যারাথনের যুদ্ধ সম্পর্কে আমরা জানি, কিন্তু সেই যুদ্ধক্ষেত্রের নামের অর্থ কি জানি সবাই? বাংলা করলে দাঁড়াবে, মৌরিগাছিয়া। ম্যারাথন মানে মৌরি, আংরেজিতে যাকে বলে ফেনেল, বৈজ্ঞানিক নাম Foeniculum vulgare। কথিত আছে, প্রমিথিউস মৌরির একটি শুকনো ডাল দিয়েই দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন। মৌরি মূলত ভূমধ্যসাগরের আশপাশের অঞ্চলের মশলা, সেখান থেকেই ডানেবামে ছড়িয়েছে। আমরা মৌরি, অর্থাৎ মৌরিগাছের বীজ খাই মশলায় আর পানে, তবে ইতালিতে এর কন্দও সালাদে ব্যবহৃত হয়, রান্নাও হয় সব্জি হিসেবে।মেথি বা ফেনাগ্রিক (Trigonella foenum-graecum) ও জিরার মতোই প্রাচীন খান্দানি বংশের জিনিস, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দেও এর দেখা মিলেছে মেসোপটেমিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে, তুত আনখ আমেনের সমাধিতে। ধারণা করা হয় এর মূল মধ্যপ্রাচ্যেই। মেথি আবিসিনীয় অঞ্চলে রুটি আর ঘি তৈরিতে বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়। মিশরে মেথির চা বেশ জনপ্রিয়। আরবে মিষ্টি তৈরিতে মেথি ব্যবহৃত হয়, সেখানে এটি হুলবা নামে পরিচিত।কালিজিরার নাম নিয়ে একটা হুলুস্থূলু কিন্তু চলমান। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nigella sativa, সেই গণ হিসেবে একে নাইজেলা সিড ডাকাটাই বোধহয় নিরাপদ, কারণ চলমান বিকল্প নামগুলি প্রায় সবক'টাই অন্য জিনিসকে নির্দেশ করে। কালিজিরার আক্ষরিক অনুবাদ আছে আংরেজিতে, ব্ল্যাক কিউমিন, কিন্তু সেটা মূলত অন্য একটি মশলা (Bunium persicum)কে নির্দেশ করে, যেটিকে হিন্দিতে শাহীজিরা বলা হয় (আমাদের দেশের রান্নায় এটি মোটেও প্রচলিত নয়)। পারসি দোকানে গেলে সিয়াদানা খুঁজতে পারেন, রুশ দোকানে গেলে চেরনুশকা, তুর্কি দোকানে গেলে চোয়রেক ওতু, হিন্দুস্তানি দোকানে গেলে কালঞ্জি। কিন্তু ইংরেজিতে একে মোটামুটি অন্য সব মশলার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। মৌরিফুল (ফেনেল ফ্লাওয়ার), রোমান ধনিয়া (রোমান কোরিয়ান্ডার), পেঁয়াজবিচি (ব্ল্যাক ওনিয়ন সিড), কালোতিল (ব্ল্যাক সেজামে), কালো পার্সিজিরা (ব্ল্যাক ক্যারাওয়ে)। একটাই স্বস্তিদায়ক নাম আছে, ব্ল্যাকসিড। কালিজিরা সুগন্ধ আর ঔষধি গুণের জন্যে বিখ্যাত। সর্দি লাগলে কালিজিরার ভর্তা খেয়ে দেখতে পারেন, বেশ কাজে দেয়। কালিজিরাও অতি প্রাচীন কাল থেকে মিশর ও আরবে পরিচিত। ধনিয়াপাতা (সিলান্ত্রো বা চাইনিজ পার্সলি) আর ধনিয়াবীজ , দু'টোই আমাদের রান্নায় কমবেশি অবশ্যম্ভাবী। ধনিয়া (Coriandrum sativum) ঠিক কোথায় প্রথম ডোমেস্টিকেটেড হয়েছে তা জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় গ্রীসে। এখন পর্তুগাল বাদে অন্য কোন ইয়োরোপীয় স্থানীয় ডিশে ধনিয়া দেখা যায় না।এবার আসল কথায় আসি। পাঁচফোড়নে কোন পাঁচ মশলা আছে, জানেন? মেথি, কালিজিরা, সরিষা, মৌরি আর জিরা। পাঁচফোড়ন কেন লাগে জানেন? রসুনের আচার বানাতে। আর রসুনের আচার আমার সেইরকম দারুণ লাগে। মশলা নিয়ে এতো গবেষণার রহস্য সেখানেই। বহু মশলা জীবনে চোখেও দেখি নাই। উইকিপিডিয়ার কল্যাণে মশলার হাই রেজোলিউশন ছবি পেয়েছি, বৈজ্ঞানিক নামের সূত্র ধরে জার্মান আর আংরেজি নামও বার করেছি। এখন শুধু দোকানে গিয়ে কেনা বাকি। এখানে আফগান দোকানে অধিকাংশ মশলার গায়েই কোন নামধাম লেখা থাকে না, তুর্কি দোকানে লেখা থাকে তুর্কি নাম। কাজেই ছবিই ভরসা। যাবি কই? রসুনের আচার আমি খামুই খামু।
ছবিসৌজন্যঃ উইকিমিডিয়াসংগৃহীত
আসুন শুরু করি দারচিনি দিয়ে। এই দারচিনির লোভেই ইয়োরোপীয়রা রাস্তা শুঁকতে শুঁকতে হানা দিয়েছিলো ভারতবর্ষে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cinnamomum zeylanicum, কারণ তা এককালে কেবল সিলোনে (শ্রীলঙ্কা) মিলতো। আরবরা এককালে দারচিনির একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ইয়োরোপ আর চীনে। তাদের গল্পটা ছিলো এমন, দারচিনি পাখি বলে একটা পাখি আছে, যা দূর দেশের অজানা সব জায়গা থেকে দারচিনির কাঠি এনে বাসা বোনে। আরবরা সেই বাসা খুঁজে খুঁজে বার করে দারচিনি জড়ো করে বিক্রি করে। এই গল্প চতুর্দশ শতকের শুরু পর্যন্ত খেয়েছে লোকে।
ছবিসৌজন্যঃ উইকিমিডিয়া
2 comments:
nice
thankz
Post a Comment