বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল রোজায় বাজার স্থিতিশীল থাকবে। দাম বাড়াবেন না বলে ব্যবসায়ীরাও প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার কোনো প্রতিফলন বাজারে পাচ্ছে না।
সবজি খেয়ে খরচ কমানোর উপায় আর নেই। আবার ইফতারে কেবল মুড়ি দিয়ে ছোলা খাওয়ার পরিকল্পনাতেও ব্যয় কমানোর সুযোগ নেই। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিদিনই।
কার্যকর কোনো তদারকিও নেই বাজারে। দাম কেন বাড়ছে তার কোনো উত্তরও জানেন না ভোক্তারা। সব মিলিয়ে এবারের রোজায়ও রোজাদারদের ভোগাচ্ছে বাজার; বিশেষ করে ছোলা, চিনি ও সবজি।
ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারদর ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং পরিবেশক নিয়োগ আদেশ বাস্তবায়নের সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য আজ বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল ও চিনির উৎপাদক, পরিশোধনকারী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে বৈঠক ডেকে দাম কমানোর নজির এখনো ঘটেনি।
চিনিতে আবার অস্থিরতা: মাত্র কয়েক দিন চিনি বিক্রি হয়েছিল সরকার-নির্ধারিত ৬৫ টাকা দরে। কিন্তু এখন আর চিনির বাজার স্থিতিশীল নেই। কয়েক দিন ধরে চিনির দাম খুচরা পর্যায়ে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে ৬৫ টাকায় এক কেজি চিনি যেমন পাওয়া যাচ্ছে, আবার অনেক দোকানি ৭০ থেকে ৭২ টাকায়ও বিক্রি করছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, পরিশোধন কারখানাগুলো সরবরাহ না করায় চিনির কিছুটা সংকট রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে সরবরাহ বাড়াতে হবে। অথচ, সরকার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, দেশে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। রমজানে কোনো সমস্যা হবে না।
জানা গেছে, দেশের ছয়টি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান চিনির বাজারের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও তিনটিতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এগুলো হলো: মেঘনা, পারটেক্স ও এস আলম। বাজারে চিনি সরবরাহ করছে মূলত সিটি গ্রুপ আর ইগলু। অল্প পরিমাণে চিনি সরবরাহ করছে দেশবন্ধু।
রমজানের আগে চিনি আমদানি না করা ও পরিশোধন কারখানা বন্ধ রাখার কারণ জানতে চেয়ে দেশবন্ধু, এস আলম, পারটেক্স ও মেঘনা গ্রুপ—এই চার প্রতিষ্ঠানকে গত ২১ জুলাই চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই জবাবে উৎপাদন শুরু করার ঘোষণা দিলেও কার্যত দেশবন্ধু ছাড়া উৎপাদনে কেউই নেই।
এসব কারণে পাইকারি বাজারে চিনির সরবরাহ এখন কম। চাহিদার তুলনায় ঘাটতিও বেশ। মৌলভীবাজারের চিনি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এখন প্রতিদিন চিনির চাহিদা আছে প্রায় পাঁচ হাজার টন, কিন্তু বাজারে সরবরাহ আছে মাত্র দুই হাজার টন। চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধন কারখানা থেকে চিনির সরবরাহ না পেলে সরকার-নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি করা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন বিদেশ থেকে চিনি আমদানি না করে ইগলুর কাছ থেকে ২০ হাজার টন ও মেঘনা থেকে ১০ হাজার টন চিনি কিনেছে। এই ৩০ হাজার টন সরকার কিনে নেওয়ায় বাজার সরবরাহ কমে যায়। এর পরিবর্তে ওই পরিমাণ চিনি সরকার সরাসরি আমদানি করলে তাহলে বাজারে চিনির সরবরাহ হতো ৬০ হাজার টন, যা দিয়ে সারা দেশে অন্তত ১৫ দিনের চাহিদা মেটানো যেত।
চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন সূত্র বলছে, এ বছর সরকারি চিনিকলগুলো থেকে উৎপাদিত চিনির পরিমাণ এক লাখ ৯৬২ হাজার টন। এই চিনি দিয়ে কোনো রকমে মানুষের এক মাসের চিনির খোরাক মেটানো যায়।
দুই মিল গেটে দুই দরে বিভ্রান্তি: খুচরা দোকানে কোথাও ৬৫ আবার কোথাও ৭০ এমনকি ৭২ টাকা কেজি দরেও চিনি বিক্রি হচ্ছে। জানা গেছে, দুটি প্রতিষ্ঠানের মিল গেট থেকে দুই দামে চিনি সরবরাহ করায় তার প্রভাব পাইকারি ও খুচরা দোকানে পড়ছে। ফলে দামেও দেখা দিচ্ছে ভিন্নতা।
জানা যায়, সিটি গ্রুপ মিল গেট থেকে চিনি বিক্রি করছে ৫৮ টাকা আট পয়সায়। সেই চিনি পরিবেশকেরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন ৬০ টাকায়। পাইকারেরা ওই চিনি খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ৬২ টাকায়। ফলে খুচরা বিক্রেতারা সরকার-নির্ধারিত ৬৫ টাকায় চিনি বিক্রি করতে পারছেন।
আরেক চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ইগলু মিল গেটে চিনি বিক্রি করে ৬২ টাকা চার পয়সায়। পরিবেশকেরা সাড়ে ৬৩ টাকায় পাইকারদের কাছে তা বিক্রি করেন। পাইকারেরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ওই চিনি বিক্রি করেন ৬৪ টাকায়। আর নিজের দোকান পর্যন্ত নিতেই খুচরা ব্যবসায়ীদের চিনির কেজিপ্রতি খরচ পড়ে যায় ৬৫ টাকা।
বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো চিনিই সরাসরি মিল থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে যায় না, মাধ্যম হয়ে যায়। সরকার এই বিষয়টি বুঝতে চায় না। আমরা আট আনা লাভে চিনি বিক্রি করে দিলেও অনেক ক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতাদের ৬৫ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয় না। তার পরও বেছে বেছে যারা ৬৫ টাকায় চিনি বিক্রি করে, সেই দোকানদারদের আমরা চিনি দিচ্ছি।’
ছোলা আকাশ ছুঁইছে: সব ধরনের ছোলার দাম এক টাকা করে বেড়েছে। রহমতগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতকাল অস্ট্রেলিয়ার ছোলা ৬২ থেকে ৬৩, উন্নত মানের মিয়ানমারের ছোলা ৮২ থেকে ৮৫ এবং ইথিওপিয়ার ছোলা ৬৯ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মঙ্গলবার চট্টগ্রামে মণপ্রতি ছোলার দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাড়ায় নতুন করে ছোলার দাম বেড়েছে।
খুচরা দোকানেও ছোলার দাম আকাশছোঁয়া। বিক্রেতারা অস্ট্রেলিয়ার ছোলা ৭০ থেকে ৭৫, মিয়ানমারের ছোলা ৯০ থেকে ৯৫, ইথিওপিয়ার ছোলা ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করছেন। কোনো কোনো দোকানে এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
জানা গেছে, জুলাই মাসের প্রথম ২৬ দিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৩ হাজার টন ছোলা ঢুকেছে। আমদানি করা ছোলার মধ্যে মিয়ানমারের ছোলার দাম পড়েছে কেজিপ্রতি ৬২ টাকা ৬২ পয়সা। পরিবহন খরচ মিলিয়ে দাম হয় সাড়ে ৬৫ টাকা। অস্ট্রেলিয়ার ছোলার আমদানি মূল্য ৪৪ টাকা ৪১ পয়সা। খরচসহ দাম হয় সাড়ে ৪৭ টাকা। আর ইথিওপিয়ার ছোলার দাম আমদানি মূল্য ৫৩ টাকা ৯০ পয়সা হলেও খরচসহ দাম পড়ে প্রায় ৫৭ টাকা। কিন্তু এই ছোলাগুলোই চট্টগ্রামের খুচরা দোকানেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ঢাকায় তো দাম আরও বেশি।
সবজির বাজারে আগুন: গত এক সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, পলাশী ও নিউমার্কেটের বনলতা মার্কেট কাঁচাবাজার ঘুরে বিক্রেতাদের চড়া দামে সবজি বিক্রি করতে দেখা গেছে।
এক সপ্তাহে আলুর দাম দুই টাকা বেড়ে ১৬ টাকা হয়েছে। টমেটো ৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। মানভেদে যে বেগুন ৩০ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, গতকাল তা বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। বাজারে ২৫ টাকার শসার দাম হাঁকেন বিক্রেতারা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ৩০ থেকে ৩৩ টাকার কাঁকরোল ৩৫ থেকে ৪০, ৪০ টাকার করলা ৫০, ২৫ টাকার পটোল ৩৫, ৩০ টাকার বরবটি ৩৫, ২৫ টাকার ঢ্যাঁড়স ৩৫ থেকে ৪০, ২০ টাকার কচুর মুখি ২৫, ২০ টাকার চিচিঙা ২৫ টাকায় বিক্রি হয়।
অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েছে কাঁচা মরিচেরও। দ্বিগুণ বেড়ে পণ্যটি এখন ১০০ টাকা পর্যন্ত। লেবুর দামও চড়া। গন্ধ লেবু (এলাচি) ২০ ও ছোট কাগজি লেবু ১৫ টাকা হালি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
খোলা সয়াবিন মেলে না: রাজধানীর দোকানে এখনো খোলা সয়াবিন তেলের দেখা মেলা ভার। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে ১০৯ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত। আর পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৪ টাকা ও সুপার পাম তেল ১০৫ টাকা। তবে মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলা সয়াবিন পাইকারিতে ১০৪ ও পাম তেল ৯৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক লিটারের সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে ১২১ থেকে ১২৫ টাকায়। আর পাঁচ লিটার বোতলজাত তীর মার্কা সয়াবিন তেল ৫৯৫, রূপচাঁদা ৬০৫ ও ফ্রেশ ৫৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment