শীতের যত অসুখ
অনেকের ধারণা, বেশিক্ষণ ঠান্ডায় থাকলে বা পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগে, সর্দি হয়। যদিও এসব রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তথাপি বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব এনজাইম আছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রায় কম কার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়, যা আমাদের শ্বাসনালির স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে ভাইরাসের আক্রমণকে সহজ করে। শুষ্ক আবহাওয়া বাতাসে ভাইরাস ছড়ানোতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিকে সরু করে দেয়, ফলে হাঁপানির টান বাড়ে।
ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশির শুরুতে গলা ব্যথা করে, গলায় খুশখুশ ভাব দেখা দেয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরতে থাকে এবং হাঁচি আসে। ক্রমান্বয়ে মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। হালকা জ্বর ও শুকনা কাশিও হতে পারে। এটা মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের রোগ এবং ৫-১০ দিনের মধ্যে নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা মূলত ফুসফুসের রোগ এবং এ ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশিটা খুব বেশি হয়। ঠান্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এ ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
এ ছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত দেহের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ আসতে থাকে, তবে তা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে। শীতের সুযোগে শুধু ফুসফুস নয়—সাইনাস, কান ও টনসিলের প্রদাহও বাড়ে।
প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় প্রত্যেকেরই এসব উপসর্গের সঙ্গে কমবেশি পরিচয় হয়। তবে এসব রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের।
প্রয়োজনমতো গরম কাপড় পরা; বিশেষ করে তীব্র শীতের সময় কান-ঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা।
ঠান্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা।
তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে।
মাঝেমধ্যে হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা।
হাত ধোয়ার অভ্যাস করা; বিশেষ করে চোখ বা নাক মোছার পরপর হাত ধোয়া।
ধুলাবালি এড়িয়ে চলা।
ধূমপান পরিহার করা।
ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।
প্রয়োজনে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নেওয়া; বিশেষ করে হাঁপানি বা দীর্ঘদিনের কাশির রোগীদের জন্য এবং যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাদের জন্য এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
হাঁপানির রোগীরা শীত শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রতিরোধমূলক ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
যদি প্রতিরোধের চেষ্টা সত্ত্বেও সর্দি-কাশি দেখা দেয়, তবু প্রতিরোধের উপায়গুলো চালিয়ে যেতে হবে। এটা শুধু রোগের তীব্রতাকে কমাবে না, রোগের বিস্তারও কমাবে। অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। পাশাপাশি দেশজ ওষুধ যেমন—মধু, আদা, তুলসীপাতা, কালিজিরা ইত্যাদি রোগের উপসর্গকে কমাতে সাহায্য করবে।
এ ছাড়া রোগ যাতে অন্যদের আক্রান্ত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত বাসায় থাকাই ভালো। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রী যারা আক্রান্ত, তাদের অবশ্যই বাসায় রাখতে হবে। নেহায়েত বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো।
কাশির মতো প্রকট না হলেও শীতে আরও অনেক রোগেরই প্রকোপ বেড়ে যায়। বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা শীতে বাড়তে পারে। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয়। শীতের শুষ্কতায় অনেকের ত্বক ফেটে যায় এবং চর্মরোগ দেখা দেয়।
তীব্র শীতে অনেকের হাতের আঙুল নীল হয়ে যায়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে যদি ঠান্ডার ওষুধে সিউডো এফেড্রিন বা ফিনাইলেফ্রিন থাকে, তবে তা-ও রক্তচাপ বাড়ায়। শীত খুব তীব্র হলে হূদযন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।
শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হাইপোথার্মিয়া, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া (৯৫০ ফারেনহাইটের নিচে), যা মৃত্যু ঘটাতে পারে। মূলত যারা পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র কিনতে পারে না এবং শিশু ও বয়োবৃদ্ধ—যাঁরা নিজেদের যত্ন নিতে অপারগ, তাঁরাই এর শিকার।
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ; ডিন, মেডিসিন অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১০, ২০১০
0 comments:
Post a Comment