চিরনতুনের ডাক দিয়ে আবার এল পহেলা বৈশাখ। জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার প্রত্যাশায় সারাদেশজুড়ে চলছে বাঙালির নববর্ষ বরণ, নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে।
ভোর সোয়া ৬টায় রাজধানীর রমনার বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। ছায়ানটের এ অনুষ্ঠান শুধু বাঙালির বর্ষবরণের প্রাণই নয়, প্রতিবাদেরও হাতিয়ার।
‘রাগ ভৈরবের’ মধ্য দিয়ে দিয়ে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর পর ‘পূর্ব গগণ ভাগে’ - কবিগুরুর এ গান গাওয়া হয় সম্মিলিত ভাবে।
এরপর পহেলা বৈশাখ ও ছায়ানটের বর্ষবরণের এ আয়োজনের তাৎপর্য তুলে ধরে সূচনা বক্তব্যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “এটি শুধু এখন ছায়ানটের অনুষ্ঠান নয়। এটি এখন জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।”
এর পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর ছায়ানটের শিল্পীরা পরিবেশন করেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ সেন, রজনীককান্ত সেন, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শাহ আবদুল করিম, লালন শাহ, তোরাব আলী শাহ, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের গান।
এর মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেন, “রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিরোধ বিদ্বেষ দূর হোক, কিন্তু মন থেকে কখনও কখনও ঘৃণা অপসারণ করা দূরহ হয়ে যায়। যারা ধর্মের নামে মনুষ্যত্যের অবমাননা করে, তাদের শাস্তি পেতেই হবে।”
জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে সকাল ৯টায় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন যখন শেষ হলো, তখন প্রস্তুতি চলছে বাংলা একাডেমীর সামনে থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এ শোভাযাত্রা বর্ষরণের উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রতিবছরই বিভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে বের হয় চারুকলার এ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যে থাকছে সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করা।
মঙ্গল শোভাযাত্রাটি শনিবার চারুকলার বকুলতলা থেকে শুরু হয়ে রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে দিয়ে ঘুরে শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি ঘুরে আবার বকুল তলায় চলে আসবে।
শোভাযাত্রায় সমুদ্রজয়কে প্রতীকিভাবে তুলে ধরতে শোভাযাত্রার সামনে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে... রূপকথার সেই ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের আদলে তৈরি ৪০ ফুট লম্বা সাম্পান।
আর ভয়ঙ্কর চেহারার একটি দানবকে যুদ্ধাপরাধীর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করার আহ্বানও থাকবে।
সাম্পান, দানব, হাতি, ঘোড়া, বাঘ ছাড়াও এবারের শোভাযাত্রায় পাতার মতো দেখতে একটি বিশেষ পাখিও রয়েছে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই নয়, রাজধানীবাসীর সঙ্গে সেই শোভাযাত্রায় অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছেন অনেকে।
এছাড়া রমনা পার্ক এলাকা, রবীন্দ্র সরোবরসহ রাজধানীর নানা স্থানে চলছে বর্ষবরণের উৎসব।
বর্ষবরণের এ উৎসবকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য সর্বক্ষণ চোখ রাখছে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রমনা বটমূলে কয়েক স্তরের নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রথমবারের দূর নিয়ন্ত্রিত সর্বাধুনিক বোমা সনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণ রোবট রাখা হয়েছে।
বর্ষবরণের এ উৎসবের জন্য শাহবাগ ও রমনা এলাকায় গাড়ি চলাচলের রুটে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলামটর থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত সড়কে শুধু হেঁটেই চলাচল করতে হয়েছে। আশপাশের কয়েকটি সড়কেও একই অবস্থা।
ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। বর্ষশুরুর সে দিনটিই এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব।
বাদশাহ আকবরের নবরতœ সভার আমির ফতেহ উল¬াহ সিরাজি বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলি সালের শুরু করেছিলেন হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের মতো মিলিয়ে নিয়ে। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেছিলেন ও পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। আর বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিলো নক্ষত্র ‘বিশাখা’র নাম থেকে।
ইতিহাসের পাতা উল্টে আরো জানা যায়, পয়লা বৈশাখে আকবর মিলিত হতেন প্রজাদের সঙ্গে। সবার শুভ কামনা করে চারদিকে বিতরণ হতো মিষ্টি। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বর্ষবরণ উৎসব চলে আসে জমিদার বাড়ির আঙিনায়। খাজনা আদায়ের মতো একটি রসহীন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় গান বাজনা, মেলা আর হালখাতার অনুষ্ঠান।
আজ আর খাজনা আদায় নেই, কিন্তু রয়ে গেছে উৎসবের সে আমেজ। সেটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে শহর বন্দর আর গ্রামে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির মাঝে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/
0 comments:
Post a Comment